বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন

ফিলিস্তিন সঙ্কট : মুসলিম উম্মাহর করণীয়

মোহাম্মাদ হাসিব উল্লাহ
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩

ফিলিস্তিন, ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা ঐতিহাসিক এক ভূমির নাম। যা মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখ-। যেখানে হজরত ইবরাহিম আ: থেকে শুরু করে বহু নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। এমন কি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: মিরাজের রাতে ফিলিস্তিনে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা মাসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বারাকাতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১)
বড়ই দুঃখজনক যে, বর্তমানে এই মাসজিদুল আকসা ইহুদি জাতি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। মুসলিমরা এখানে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। তাই তো এই ইহুদি জাতি সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা জমিনে ফিতনা তথা অশান্তি ছড়িয়ে বেড়ায়। আর, আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা মায়েদা : ৬৪) ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, হজরত ওমর রা:-এর শাসনামলে মুসলমানরা জেরুসালেম শহরের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু, একাদশ শতাব্দীতে সংঘটিত ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে বাইজেন্টাইন সম্রাটরা এই শহর দখল করে। পক্ষান্তরে, কাফেরদের হৃদয় কাঁপানো সুলতান গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক ১১৮৭ সালে দ্বিতীয় ধর্মযুদ্ধে বায়তুল মাকদাস ও তৎসংশ্লিষ্ট শহর বিজয় করে নিয়ন্ত্রণ নেন। যা শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম সম্রাটদের অধীনে ছিল। তবুও কাফেররা এই ভূমি দখল করতে নানান পরিকল্পনার কমতি রাখেনি। যেমন ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী দীপ্তকণ্ঠে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা করে। যা বেলফোর ঘোষণা নামে সমধিক পরিচিত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২২ সালে বিলুপ্ত লীগ অব নেশনসের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ফলে, সেখানে অবস্থানরত ইহুদি জাতির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। আর, মুসলিমরা নিজ রাষ্ট্রে নির্বাসিত হয়। এ ছাড়াও, ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুপ্ত সংগঠন ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। ফলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তথা ১৯৪৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখে পরিণত হয়। এমনকি বিশ্বশান্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘জাতিসঙ্ঘ’ ফিলিস্তিনে মুসলিমদের স্বাধীনতার জন্য কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। কৌশলে তারা ইহুদিদের পক্ষালম্বন করে থাকে। যেমন ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখ-কে ভাগ করে ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের এবং ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জন্য নির্ধারণ করে দু’টি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়। যা খুবই অন্যায় ও নীতিপরিপন্থী কাজ ছিল। আরব রাষ্ট্রসমূহ এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি। বরং তীব্র বিরোধিতা করে। তবে কোনো ফল হয়নি। পরবর্তীতে, ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল বিজয় লাভের মাধ্যমে গাজা অঞ্চলও দখল করে নেয় এবং অদ্যাবধি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে, সে সময় থেকে ওখানকার মুসলিমরা নিজেদের অঞ্চলে চূড়ান্তভাবে নির্বাসিত এবং কর্তৃত্ব গ্রহণে ইহুদি জাতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।
বর্তমান সময়েও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস বাহিনীর সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ চলছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক নিষিদ্ধ বোমা-বারুদ গাজা উপত্যকায় ইসরাইল সরকার ব্যবহার করছে। যা জঘন্য ও নীতিপরিপন্থী কাজ। ফলে, ছোট্ট শিশু থেকে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে গাজা অঞ্চলে ৭টি গির্জা ও ১৭টি হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে এবং ৫৯টি হাসপাতাল আক্রমণের শিকার হয়েছে। পাশাপাশি ১৭৮টি শিক্ষাকেন্দ্র, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০টি জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত স্কুল আক্রান্তের শিকার হয়েছে। এমনকি প্রায় ৩০ শতাংশের অধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বিমান হামলার মাধ্যমে ৪৬৫১ জন হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে।’ অথচ এহেন সময়েও জাতিসঙ্ঘ নীরব ভূমিকা পালন করছে। কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ইসলাম ও মুসলমানদের বিনাশে যেন তারা একত্রে কাতারবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের ভূমিকা বেশ লক্ষণীয় ছিল। তাই, এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের অবশ্যই একতাবদ্ধ হতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক করে ইসরাইলি আগ্রাসনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। যা খুবই প্রশংসনীয়। অনুরূপভাবে আরব বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের একজোট হয়ে কাজ করতে হবে, তবেই তা ফলপ্রসূ হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মুসলিমদের যে সোনালি অতীত রয়েছে ও ইসলামের স্বার্থে এখনো একতাবদ্ধ হতে পারে, এ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে কড়া বার্তা দিতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ‘মুসলমানরা যখনই আল্লাহর ওপর ভরসা করে কৌশলে শত্রুর মোকাবেলা করেছে, তারা বিজয় অর্জন করেছে। সৈন্য সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশি। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধই এর সাক্ষ্য বহন করে।’ এজন্যই কাফেরদের সাথে মোকাবেলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা কাফিরদের মুকাবিলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদাসজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। যার দ্বারা আল্লাহর শক্র ও তোমাদের শক্রদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে।’ (সূরা আনফাল : ৬০)
পাশাপশি, ওআইসি কর্তৃক সদস্যভুক্ত দেশ নিয়ে জরুরি সম্মেলন আয়োজন ও ফিলিস্তিনের গাজা অধিবাসীদের জন্য জরুরি সহায়তা প্রদানে পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। শরিয়াহর দৃষ্টিতে, তারা কাফেরদের দ্বারা নির্যাতিত ও মজলুম জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহকে তাদের সহায়তায় অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, মজলুমদের সহায়তা করতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: উৎসাহ প্রদান করেছেন। (বুখারি : ৫১৭৫)
এমনকি জাতিসঙ্ঘ যেন ফিলিস্তিন সঙ্কট সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেজন্য মুসলিম বিশ্বকে কাতারবন্দী হতে হবে এবং প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘকে বয়কট করতে হবে। পাশাপাশি, সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে গাজা উপত্যকার সংবাদ প্রচারে সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। যেন বিশ্ববাসী ওদের হত্যাযজ্ঞের খবর নিমেষেই জানতে পারে। পরিশেষে, ইসরাইলের ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ ও ফিলিস্তিনের প্রতি পূর্ণ সমর্থনে মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা একতাবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করা যাবে না।
লেখক : তরুণ গবেষক ও লেখক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com