মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। আদিকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। মাছের সাথে যে বাঙালির নিবিড় সম্পর্ক তার আরও একবার প্রমাণ মিলেছে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় হাইত উৎসবে। সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই মাইকিং ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাইত উৎসবের খবর। উৎসবের আগের রাতেই বিল এলাকার আশে পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন হাজার হাজার শৌখিন মাছ শিকারি। ছোট থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের ঢল নামে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী বলদা বিলে। ফজরের নামাজের পরই ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, গৌরীপুর ও কেন্দুয়া সহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ এসে জড়ো হন বিল পাড়ে। কারো হাতে পলো, কারো হাতে জাল। সবার গন্তব্য বিল। ঘাসের ডগা থেকে শিশির বিন্দু পরার আগেই কুয়াশা ঢাকা ভোরে বিলের চারদিক থেকে মাছ ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। ৫ নভেম্বর ২০২৩ রোববার উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের দত্তগ্রাম এলাকার বলদা বিলে মাছ ধরার এমন হাইত উৎসব হয়। বিলটি ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল এই দুই উপজেলা জুড়েই বিস্তৃত। স্থানীয়রা জানান, তিন থেকে চার বছর আগে এই বলদা বিলে হয়েছিল হাইত উৎসব। পরে কয়েকবছর ধরে আর হয়নি এমন উৎসব। এবার সেই আক্ষেপ পূরণ হয়েছে বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষের। ‘হাইত’ উৎসবে নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে শিশুদের উপস্থিতিও ছিলো চোখে পড়ার মতো। তাদের মধ্যে অনেকেই জীবনে প্রথম বারের মতো জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমেছেন। গ্রামীণ মাছ ধরার উৎসব দিনদিন কমে আসায় এ উৎসব দেখতে ভিড় করেন বিভিন্ন এলাকার উৎসুক মানুষও। মাছ ধরা দেখে আনন্দ পান অনেকে। থেমে থেমে হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠেন উৎসবে মাছধরা মানুষ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বলদা বিলের এই মাছ শিকারের উৎসব। এলাকাবাসী ও হাইত উৎসবে আসা মৎস্য শিকারীরা জানান, খাল-বিল, জলাশয়ে বছরের এ সময়টাতে পানি কমে হাঁটু সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোমর সমান হয়ে এলে ‘হাইত উৎসবে’র আয়োজন করেন এলাকার মানুষজন। দিনক্ষণ ঠিক করে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পার্শ্ববর্তী নান্দাইল থেকে আসা বৃদ্ধা কাঞ্চন মিয়া ও গৌরীপুর থেকে আসা আরেক বৃদ্ধা মুরাদ হোসেন বলেন, আগে হাউক উৎসবে অনেক মাছ ধরা পড়তো, এবার এসে তেমন মাছ পাইনি। তবে সবার সঙ্গে মাছ ধরতে বিলে নেমে ভালো লাগছে, এতেই আমরা খুশি। জীবনে প্রথমবার হাইত উৎসবে আসা ঈশ্বরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মো. শরিফ উদ্দিন ও রায়হান আহমেদ বাবু জানান, আমরা জীবনের প্রথম এবার হাউক উৎসবে এসেছি। মোটামুটি মাছ পেয়েছি, তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী পাইনি। আগে বাবা-দাদার মুখ থেকে শুধু হাইত দিয়ে মাছ শিকারের গল্প শুনতাম। কিন্তু এবার বাস্তবে এসেছি মাছ ধরতে। মাছ কম পেলেও এমন উৎসবে এসে খুব ভালো লাগছে। হাইত উৎসবে উপজেলার জাটিয়া ইউনিয়ন থেকে পলো নিয়ে আসা মাছ শিকারি রফিকুল ইসলাম ও এমদাদুল হক বলেন, মোটামুটি ভালো মাছ ধরেছি। আমরা বোয়াল, রুই-কাতল ও শোল মাছ পেয়েছি। এছাড়াও যাঁরা ঠেলা জাল ও টানা জাল নিয়ে এসেছে তারা প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ শিকার করেছে। এবিষয়ে মাইজবাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইদুল ইসলাম বাবুল বলেন, হাইত উৎসবে হাজার হাজার মানুষ এসেছে মাছ শিকার করতে। এতে আমার এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে ঈদের মতো আনন্দ বিরাজ করছে। বিলুপ্ত প্রায় এই উৎসব ঘিরে মানুষের মাঝে বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে। দূর-দূরান্ত থেকেও অনেক মাছ শিকারিরা এসেছে। সব মিলিয়ে ভালো একটি দিন কেটেছে মাইজবাগ ইউনিয়ন তথা পুরো ঈশ্বরগঞ্জবাসীর।