বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২০ অপরাহ্ন

জোট-মহাজোটের দলাদলি ও রাজনীতি

ইয়াসিন মাহমুদ:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

মন্তব্য প্রতিবেদন
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ মূলধারা সব রাজনৈতিক দল তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। একটানা এই ১৫ বছর শাসনক্ষমতায় আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের শরীকরা সরকারের নানা নির্যাতনে পিষ্ট। এখন চলছে তাদের সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে জাতীয় মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দেয়। প্রশাসন জামায়াতকে শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। অবশ্য জামায়াতে ইসলামী আরামবাগ মোড়ে তাদের সমাবেশ করে। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সরকার ও প্রশাসনের নানামুখী চাপে বিএনপি-জামায়াতের জন্য এই মহাসমাবেশ ছিলো বেশ চ্যালেঞ্জের। সরকার বারবার চেয়েছিলো যেকোন মূল্যে বিরোধী জোটের এই সমাবেশ বন্ধ করতে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলো। গত ১৬ অক্টোবর ২০২৩ যুবলীগের সমাবেশে খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন-শেখ হাসিনা কারো কাছে মাথা নত করেন না। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেন না। জনগণ যতক্ষণ সাথে আছেন ততক্ষণ ভয় নেই। তিনি আরো বলেন- যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ সবাই প্রস্তুত আছে। এবার অবরোধ করলে বিএনপিই অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। পালাবার পথ পাবে না। শাপলা চত্বরের চেয়েও করুণ পরিণতি হবে তাদের। [ দৈনিক মানবজমিন, অনলাইন সংস্করণ- ১৬ অক্টোবর ২০২৩] ২৮ অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের শরীকদের এই সমাবেশকে শুরু থেকেই সরকার থ্রেট মনে করেছে। অবশ্য সমাবেশের তারিখ ঘোষণার সাথে সাথে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ঢাকায় আসতে শুরু করে। সমাবেশের এক সপ্তাহ আগেও দলগুলোর হাজার-হাজার নেতা-কর্মীরা ঢাকায় অবস্থান করেন। বিষয়টা সরকার ও প্রশাসনের রিপোর্টে ছিলো। সরকার এই সমাবেশকে প্রচণ্ড পরিমাণ ভয় পেয়েছে। এই জনরোষ কিংবা জনস্রোত যদি রুখা অসম্ভব হয় তাহলে সরকারের টিকে থাকার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে যায়। আর সেই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করেছে সরকার। ফলে সমাবেশের কয়েকদিন আগ থেকে ঢাকার প্রবেশ পথে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে যাত্রীবাহী যানবাহনে ব্যাপক তল্লাশি ও গণগ্রেফতার শুরু করে। শত ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দলগুলো তাদের সমাবেশ শুরু করে। জামায়াতের সমাবেশের শেষের দিকে পুলিশের গুলিতে আহত হয় অনেকে। অন্যদিকে পুলিশের হামলায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও বুলেটের আঘাতে আহত হয় শত শত নেতা-কর্মী। সমাবেশস্থলে যুবদলের এক কর্মীর মৃত্যু ঘটে। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলের আঘাতে সাংবাদিক নেতা রফিক ভূঁইয়াও ইন্তেকাল করেন। এদিকে পুলিশের দাবি-ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের হাতে নিহত হয় পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ব্যাপারেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি অভিযোগ এনেছে পুলিশ। বিএনপির সমাবেশ ভণ্ডুল, শীর্ষ নেতা-কর্মীসহ সারাদেশে চিরুনী অভিযান চালিয়ে নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতার ও গুলি করে হত্যার মাধ্যমে নেতৃত্বশূন্য করার পাঁয়তারা চলছে। এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপি ও জামায়াতসহ তাদের শরীকরা হরতাল, অবরোধ অব্যাহত রেখেছে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা নিয়ে নানা মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ঐদিনের ঘটনাটি ছিলো বেশ সিনেম্যাটিক। এই রহস্য হয়তো এখন উদঘাটন না হলেও কোন একদিন সত্য বেরিয়ে আসবে। বিএনপি কর্মীরা কি বিনা উস্কানিতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলো নাকি পুলিশের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিলো?-সে প্রশ্ন রয়ে যায়। পুলিশের ভেস্ক পরে কারা পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়, কারা কাকরাইল মোড়ের পুলিশবক্সে আগুন দেয় এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায়? ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে ভণ্ডুল করে ক্ষান্ত হয়নি সরকার। বিএনপির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার অব্যাহত রাখছে। মহানগর, জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যন্ত এই অভিযানের আওতায় নিয়েছে সরকার। প্রতিদিন গ্রেফতার অভিযান চলছে। সরকার যে এমন একটি মারমুখী অবস্থানে যাবে সেটা সমাবেশের আগে থেকে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। গত ২৩ অক্টোবরের দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পেজের নিউজটি ছিলো এমন-নিরাপত্তার ‘ঘাটতি’ দেখা দিলেই শক্তি প্রয়োগ। পুলিশ সত্যি সত্যিই শক্তি প্রয়োগ করে চলেছে। তবে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা নিয়ে অনেক মন্তব্য আসছে। যেমন-পুলিশ যদি সত্যিকারের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতো তাহলে পুলিশের সামনে কেউ পুলিশবক্সে আগুন দিতে পারতো না। বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালাতে পারতো না। বাসে আগুন দেবার সাহস করতো না। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ প্রযোজনায় যে এই হামলা, সেটা বুঝতে আর কারো বাকি নেই। মজার ব্যাপার হলো- ঢাকার প্রবেশপথ থেকে সমাবেশস্থলে আসা বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে তল্লাশি ও গ্রেফতার করলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই আইনের আওতামুক্ত ছিলো। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশ সদস্যের উৎসুক মনোভাবে হ্যান্ডসেক করার ছবি এখন অনলাইন দুনিয়ায় ভাসছে। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে সবাই লগি বৈঠা ও আগ্নেয় অস্ত্র প্রদর্শন করলেও তাদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। তাদের নামে মামলা হয়নি। অথচ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিরোধী জোটের নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর পুলিশি হামলার বর্বরতা দেখে বিশ্ববাসী আজ স্তম্ভিত। এখন প্রশ্ন আসতে পারে-বিএনপি কি তাহলে পরাজিত হয়ে গেছে? বিএনপির পরাজয় হয়েছে এ কথা বলবো না। তারা চেয়েছিলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে। সর্বশেষ পর্যন্ত তারা সেটি করবার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। তবে সমাবেশে বিএনপি নেতা-কর্মী, বিশেষ করে সমাবেশের স্টেজকে লক্ষ্য করে পুলিশের হামলা সত্ত্বেও সমাবেশে যোগ দিতে আসা বিএনপির লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী থাকতেও পুলিশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোন সংঘর্ষে যায়নি দলটি। বিষয়টা একটু স্পষ্ট করা দরকার-ঐ দিন বিএনপির মহাসচিবসহ সকল নেতৃবৃন্দকে শান্ত থাকতে দেখা গেছে। তারা সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দেয়নি। বরং ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবার চেষ্টা করেছে। ঐ দিন বিএনপিও যদি পুলিশের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতো উভয়পক্ষের আরো অনেকে হতাহতের শিকার হতো। সর্বসাকুল্যে এ কথা বলা যায়- বিএনপির কোন পরাজয় হয়নি। তবে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যে চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। দেশে যে চরম অস্বস্তিকর একটি পরিবেশ বিরাজ করছে তার উত্তরণ ঠিক কিভাবে তা সহজে অনুমেয় নয়। এখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে বাংলাদেশ সে ভবিদ্ব্যাণী করাও কঠিন। একদলীয় শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের কবলে জিম্মি হওয়া আমার প্রিয় মাতৃভূমি কবে মুক্ত হবে তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। তবে এ কথা সত্য- মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে থাকে। মেঘের পর্দা ভেদ করে একদিন ঠিকই উদিত হয় পূব আকাশে। আর সাথে সাথে দূরীভূত হয়ে যায় সকল অন্ধকার। আলো ঝলমলে সকালে চিকমিক করে চারিপাশের পরিবেশ। মানুষের মনে ফিরে আসে স্বস্তি ও শান্তি। উৎফুল্ল হয়ে মানুষেরা ঘুরতে থাকে শহর ও গ্রামের পথ ধরে। এ এক অনাবিল প্রশান্তি। এমন একটি সুদিন নিশ্চয় ফিরে আসবে সেই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com