বর্ণাঢ্য আয়োজনে মনিপুরী সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা উৎসব পালিত হয়েছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর গ্রামে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধার প্রেমলীলাকে ঘিরে মহারাসলীলা উৎসব সমাপ্ত হয় ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার কার্তিকের পূর্ণিমা তিথির ঊষালগ্নে। প্রতিবারের মতো এবারও জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ঢল নামে এ রাসোৎসবে। মনিপুরী সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষ্যে মণিপুরি ললিতকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মনিপুরী তাতঁবস্ত্র প্রদর্শনী ও শিববাজার এলাকায় বিশাল মেলা বসে। ২৭ নভেম্বর সোমবার দুপুরে উভয়স্থানে রাখালনৃত্যের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল মহারাসলীলা উৎসব। মাধবপুর জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ও আদমপুরের মনিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সসহ আরো দুটি মন্ডপ প্রাঙ্গণে মনিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ মহারাসলীলা উৎসব। মহারাসলীলা উৎসবকে ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। বসেছিল বিশাল মেলা। উৎসবে যোগ দিতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে এসেছিলেন হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী পর্যটক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয় ভিড় সামলাতে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যবনিকার দিকে এগিয়ে যায় গোপিনীদের নৃত্য, একসময় সূর্যোদয় হলে আসর ভাঙে মহারাসলীলার। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীদের ১৮১তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে মনিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি যোগেশ্বর সিংহের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ ও নির্মল সিংহ পলাশের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ। অতিথি ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজি (অ্যাডমিন এন্ড ফিন্যান্স) সৈয়দ হারুন অর রশীদ, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান পিপিএম (বার) ও কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন। বক্তব্য রাখেন মাধবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আসিদ আলী, মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিনহা প্রমুখ। অপরদিকে, আদমপুর মনিপুরী মহারাস উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কমিটির আহবায়ক থৌনাওজম নিরঞ্জন সিংহের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কবি সনাতন হামোম এর সঞ্চালনায় আদমপুর মনিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে মৈতৈ মনিপুরী সম্প্রদায়ের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মনিপুরী মহারাসলীলা উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন। এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব সত্যজিত কর্মকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন, ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র কালচারাল ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার তখেলম্বম ইরাবত ও মুতুয়া মিউজিয়াম এর পরিচালক মুতুয়া বাহাদুর। মনিপুরীদের রাসলীলার অনেক ধরন। এগুলো হলো- নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, বসন্তরাস, মহারাস, বেনিরাস বা দিবারাস। শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে হয় বলে মহারাসকে মণিপুরীরা পূর্ণিমারাসও বলে থাকেন। মনিপুরী অধ্যূষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে আশ্বিন মাসের শেষভাগেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। মণিপুরি সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনও মেতে ওঠে একদিনের এ আনন্দ উৎসবে। উল্লেখ্য- মনিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাসপূর্ণিমা বা রাস উৎসব শরতের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়। এর আবেদন ধর্মের সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে। উপজেলার মাধবপুর শিববাজারে মনিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায় ১৮১ বছর ধরে এবং আদমপুরের তেতইগাঁওয়ে মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায় ৩৮ বছর ধরে রাস উৎসব উদযাপন করে আসছেন। রাস উৎসবের দুটি পর্ব। দিনের বেলায় রাখালরাস আর রাতে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়। রাখালরাসের ম-লী বা মঞ্চ মাঠের মাঝখানের ভূমি সমতলে হয়ে থাকে- যাকে ঘিরে থাকে বৃত্তাকারে কলাগাছের বেষ্টনী। চারদিকে বসে মেলা। দেশের নানা জায়গা থেকে সওদাগরের দল এই এক দিনের জন্য আগের দিন থেকে এসে পসরা সাজায়। সঙ্গে থাকে মণিপুরীদের পোশাক, হস্তশিল্প, বইপুস্তক ইত্যাদি। রাখালরাস শেষ হয় গোধূলি বেলায়। কৃষ্ণ তাঁর গোপ সখাদের নিয়ে গরুর পায়ের খুরে রাঙা আলোয় ধূলি ওড়াতে ওড়াতে ঘরে ফিরে আসেন। রাখালরাস শেষেই কিন্তু দিনের মেলা সাঙ্গ হয়না। লোকজনের কেনাকাটা, গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া চলতে থাকে। তারপর রাতে উন্মুক্ত মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাসের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা হয়, আধুনিক গান-নাচ-নাটক, এসবও বাদ যায়না। পরম আরাধ্য এক সত্তার সঙ্গে মানুষের প্রেমাকুল আত্মার মিলনকে গীত-নৃত্য-বাদ্যযন্ত্র সহযোগে প্রকাশ করার এক নিপুণ শৈল্পিক পরিবেশনা রাস। শ্রীমদ্ভগবত, চৈতন্যদর্শন কিংবা বৈষ্ণবীয় সহজিয়া ধারার দর্শনের সীমা ছাড়িয়ে যা মনিপুরী জনপদের নিজস্ব শিল্প প্রকাশরীতির সঙ্গে মিলেমিশে নতুন এক অবয়ব নিয়েছে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যাপিত জীবনের বেদনা ও অনুভূতি যেখানে স্পন্দিত হয়ে ওঠে। মণিপুরী রাসলীলা প্রবর্তনের প্রচলিত গল্প অনুযায়ী- মণিপুরের মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র যখন কাঞ্চিপুর নামের এক অঞ্চলে বাস করতেন, তখন এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ নিকটবর্তী ভানুমুখ পাহাড়ে কাঁঠালগাছ হয়ে রাজার জন্য অপেক্ষা করছেন। পরদিনই রাজা সেই পাহাড়ে গিয়ে কাঁঠালগাছ খুঁজে পেলেন। গাছটি কেটে রাজধানীতে আনা হলো। রাজধানীর খ্যাতনামা শিল্পীকে রাজা তার স্বপ্নে দেখা কৃষ্ণমূর্তির অনুকরণে কাঠের মূর্তি গড়তে আদেশ দিলেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যেই তিনি ওইবছর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পূর্ণিমাতে মহারাসলীলা উৎসব প্রবর্তন করেন। মেয়ে বিম্বাবতীও সেই রাসে অংশ নেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭৭৯ সালে। রাসলীলার গানগুলো বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জয়দেব, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের পদাবলি থেকে সংগৃহীত। বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলি ও সংস্কৃত ভাষার পদ সংকলিত হলেও সাম্প্রতিক কালে মনিপুরী ভাষাতেও (বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ) রাসলীলার পদ বা গান রচিত হচ্ছে। সবশেষে রাধা-কৃষ্ণের যুগলরূপের আরতি করা হয়। কিন্তু, পরমাত্মা কৃষ্ণ তো জীবাত্মা রাধার সঙ্গে চির-একাত্ম হতে পারেন না। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র মতো তার আসা-যাওয়ার লীলা। তাই, নিশান্তে কৃষ্ণের বচনানুসারে রাধা ও গোপিণীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যায়। এই প্রত্যাবর্তন গভীর বেদনাবহ, পরম পুরুষের বিচ্ছেদের সুরে ঘেরা। রাধার চোখের জলে ফেরার সে পথ ধোয়া। রাসলীলায় কৃষ্ণসঙ্গ লাভের এই একটি রাত রাধার জীবনে একটি কালেরই প্রতীক- যার আঁধারে প্রতিটি বৈষ্ণব খুঁজে চলে পরম স্বত্ত্বাকে অনুভবের স্পন্দন। এরই আঁচ নিয়ে ভোরবেলায় ভক্তবৃন্দ ফিরতে থাকেন আপন আপন নীড়ে।