আমানতদারিতা একটি মহৎ গুণ। যার মধ্যে এ গুণ বিদ্যমান থাকবে সে অবশ্যই মহান ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে আমানতদারিতার অনেক ফজিলত ও তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে।
আমানত অর্থ বিশ্বস্ততা, নিরাপত্তা, সততা, আস্থা ইত্যাদি। আমান অর্থ নিরাপত্তা, শান্তি, আশ্রয়, রক্ষা। আমিন অর্থ বিশ্বস্ত, আল-আমিন অর্থ অতি বিশ্বস্ত। যা আমাদের প্রিয় নবী সা:-এর উপাধি। হজরত জিবরাইল আ:-এর উপাধি (আর রুহুল আমিন) বিশ্বস্ত আত্মা। কারণ, তিনি যথাযথভাবে আল্লাহর বাণী মহানবী সা:-এর কাছে পৌঁছিয়েছেন। আমানতের মূল অক্ষর আলিফ, মিম ও নুন থেকে ঈমান বা বিশ্বাস। এর থেকেই মু’মিন বিশ্বাস। আমানতদারিতার গুরুত্ব : ইসলামে আমানতদারির গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করার জন্য তোমাদেরকে নিদের্শ দিচ্ছেন।’ (সূরা নিসা-৫৮) আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খিয়ানত করো না।’ (সূরা আনফাল-২৭) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘একজন বিশ্বস্ত ফেরেশতা তা নাজিল করেছে।’ (সূরা আশ শুয়ারা-১৯৩)
মু’মিনের গুণ : আমানতদারিতা মু’মিনের বিশেষ গুণ। ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুশরিক ও মুনাফিকদের গুণ হলো আমানতের খিয়ানত করা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা মু’মিন তারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ (সূরা মু’মিন-৮, সূরা মাআরিজ-৩২)
আমানতদারিতার সম্পর্ক ঈমানের সাথে : মহানবী সা: বলেন, ‘যার মধ্যে আমনতদারিতা নেই তার ঈমান নেই এবং যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার মধ্যে দ্বীন নেই ।’ (বায়হাকি, মিশকাত পৃষ্ঠা-১৫)
আমানতের খিয়ানত করা মুনাফিকের আলমাত : মহানবী সা: বলেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- ১. যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে; ২. যখন ওয়াদা করে এর বরখেলাপ করে এবং ৩. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, এতে খিয়ানত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত পৃষ্ঠা-১৭)
নবীরা হলেন আমিন বা বিশ^স্ত : নবীরা হলেন আমিন (বিশ্বস্ত) আর আমাদের নবী সা: হলেন (আল-আমিন) অতিবিশ্বস্ত। মিসরের বাদশাহ আজিজে মিসর হজরত ইউসুফ আ:-এর সাথে কথা বলে তাঁর সম্পর্কে বলেছেন- ‘তুমি আজ সত্যিই আমাদের কাছে একজন সম্মানী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি।’ হজরত নূহ আ: প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বললেন হে আমার জাতি! তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করো না? অবশ্যই আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসূল।’ (সূরা আশ-শূয়ারা : ১০৬-১০৭) আল্লাহ তায়ালা হজরত হুদ আ: প্রসঙ্গে বলেন- ‘যখন তাদের ভাই হুদ তাদের বললেন, একি হলো তোমাদের, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? অবশ্যই আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর প্রেরিত একজন বিশ্বস্ত রাসূল।’ (সূরা আশ-শূয়ারা: ১২৪-১২৫) হজরত সালেহ আ: প্রসঙ্গে বলেন- ‘যখন তাদের ভাই সালেহ তাদের বলেছিলেন, তোমাদের এ কী হলো? অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল।’ (সূরা আশ-শূয়ারা : ১৪২-১৪৩) হজরত লুত আ: তাদের বললেন, এ কী হলো তোমাদের, তোমরা কি আল্লাহর আজাব কে ভয় করবে না? অবশ্যই আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ^স্ত রাসূল।’ (সূরা আশ-শূয়ারা : ১৬১-১৬২)
হজরত শুয়াইব আ: প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘শুয়াইব তার জাতিকে বলেন, হে আমার জাতি! তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসূল।’ (সূরা আশ-শূয়ারা : ১৭৭-১৭৮) মূসা আ: ফেরাউনকে বললেন, আল্লাহ তায়ালার এই বান্দাদেরকে তোমরা আমার কাছে দিয়ে দাও, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল।’ (সূরা আদ দুখান : ১৭-১৮)
নিরাপদ ও শান্তির স্থানকে ‘মাকামে আমিন’ বলা হয়। যেমন- আল্লাহর বাণী- মুত্তাকি ব্যক্তিরা নিরাপদ অনাবিল শান্তির জায়গায় থাকবে।’ (সূরা আদ দুখান- ৫১) মক্কা নগরীকে বলা হয়েছে নিরাপদ নগরী। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘শপথ এ নিরাপদ (মক্কা) নগরীর।’ (সূরা আত-তিন-৩)
পিতা-মাতার কাছে সন্তান আমানত : সন্তান পিতা-মাতার কাছে পবিত্র আমানত এ আমানতকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে হবে। কেননা, পিতা-মাতা সন্তানকে যে রূপ বানাতে চায় তাই হয়। মহানবী সা: এ আমানতের হক আদায়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘প্রত্যেক শিশু ফিতরাত তথা বিশুদ্ধ প্রকৃতির ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি বানায়, খ্র্রিষ্টান বানায় কিংবা অগ্নিপূজক বানায়। (মুসলিম দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৩৬ মিশকাত) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন- ‘সন্তানের জন্মের সপ্তম দিন আকিকা করতে হবে, তার নাম রাখতে হবে, তার মাথা মুণ্ডন করতে হবে। যখন সে ছয় বছরে পৌঁছবে, তখন থেকে তাকে শিষ্টাচার শিক্ষাদান করতে হবে। যখন সে সাত বছরে পৌঁছবে তখন সালাতের আদেশ করতে হবে। যখন সে ৯ বছরে পৌঁছবে তখন তার বিছানা আলাদা করে দিতে হবে। যখন ১০ বছরে পৌঁছবে তখন সারাতের জন্য মৃদু প্রহার করবে (ইবন হিব্বান)। রাসূল সা: অন্যত্র বলেন- ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যাসন্তান থাকে, আর সে ধৈর্যের সাথে তাদের লালন-পালন করে এবং নিজের সম্পদ থেকে তাদের পানাহার ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে, এটি তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে পরিগণিত হবে।’ (মুসনাদ আহমদ)
সন্তানের জন্য দোয়া করতে হবে,যেমন- আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে আমাদের রব আপনি স্ত্রী ও সন্তান সন্ততিদের থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করুন (উপরন্তু আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানান।’ (সূরা ফুরকান-৭৪) এক ব্যক্তি হজরত উমর ফারুক রা:-এর খেদমতে হাজির হয়ে পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমার পুত্র আমার কথা মানে না এবং আমার হক আদায় করে না। হজরত ওমর রা: ছেলেটিকে ডেকে এনে নসিহত করলেন এবং তাকে ভবিষ্যতে পিতার অনুগত হয়ে থাকার উপদেশ দেন।
ছেলেটি আরজ করল, হে আমিরুল মু’মিনিন ‘পিতার উপর সন্তানের কোনো হক আছে কি? হজরত উমর রা: বললেন, নিশ্চয়ই আছে। পুত্র বললেন, তা কী? হজরত উমর রা: বললেন তিনটি হক আছে- ১. সৎ সন্তান লাভের জন্য বংশমর্যাদায় উত্তম এবং চরিত্রগুণে ভূষিতা নারীকে স্ত্রীরূপে নির্বাচন করা; ২. সন্তানের ভালো নাম রাখা এবং ৩. সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেয়া।
ছেলেটি বলল, হে আমিরুল মু’মিনিন! আমার পিতা এ তিনটির মধ্যে একটিও করেনি। সে বলল- ১. আমার মা এক অগ্নিপূজকের মেয়ে। ২. তিনি আমার নাম রেখেছেন ‘ছারপোকা’ এবং ৩. তিনি কুরআনের একটি অক্ষরও আমাকে শিক্ষা দেননি। এরপর হজরত উমর রা: পিতাকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি নিজের ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ করতে এসেছ, তুমি নিজেই তার হক আদায় করোনি। তার দুর্ব্যবহার করার আগে তুমি তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছ। মহানবী সা: বলেন, ‘যারা ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না তারা আমার উম্মতের অর্ন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ)
আধুনিক কবি সম্রাট আহমদ শওকি বলেন, যে পিতা-মাতা সন্তানকে জ্ঞান ও ন্যায়নীতি শিক্ষা দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে মারা যায়, সে সন্তান এতিম নয়; বরং এতিম হলো ওই সন্তান যার পিতা-মাতা মৃতুকালে অঢেল সম্পদ রেখে গেছে; কিন্তু সন্তানকে জ্ঞান, সততা ও ন্যায়নীতি শিক্ষা দিয়ে যায়নি।
জনৈক মনীষী বলেন, ‘তোমার সন্তানের সাথে প্রথম সাত বছর মিশে খেলা করো, পরবর্তী সাত বছর তাকে প্রশিক্ষণ দাও, তৃতীয় সাত বছর তার সঙ্গ দাও, এরপর তার ভার-দায়িত্ব তার ওপর ছেড়ে দাও। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী