বিশ্বের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে এবং এর প্রভাবে আন্তদেশীয় সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকেও এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন ঝুঁকি আছে, তেমনি লাভবান হওয়ার সুযোগও আছে। পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতির এই চিত্র তুলে ধরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এই পরিস্থিতিতে বলা যায়, সরকারের যত জনসমর্থন থাকবে, ততই বৈদেশিক অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে তার রাজনৈতিক স্বার্থের সমন্বয় করা সহজ হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অন্যায় সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা ততই সামলানো যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভূরাজনীতির পরিপূরক হিসেবে ভূ–অর্থনীতির বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, এটাই হলো বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের আজ শনিবার শেষ দিন সকালে এক লোকবক্তৃতায় এসব কথা বলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, ‘বিকাশমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও ভূরাজনীতি: স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কী বাস্তবতা’।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মূল বক্তব্য শেষ করার পর বিশ্বায়ন, বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ও আলোচনা করেন অর্থনীতিবিদেরা। এই অধিবেশন স ালনা করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার।
জাইদী সাত্তার বলেন, ব্রেটন উডস সম্মেলনের পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতি নব্য উদারনীতিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। সেখান থেকেই বিশ্বায়ন। সেই ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলা ঠিক হবে না, তবে গত ১০ বছরে এর গতি কমেছে। বিশ্বায়নের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ প্রবল হচ্ছে, যা একধরনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে। এমনকি বিশ্বায়নের প্রবক্তারাও এখন সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করছে। এই বাস্তবতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো কী করতে পারে, তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তৃতার শেষাংশের পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের প্রশ্ন ছিল এ রকম, সরকারের বৈধতার বিষয়টি কি কেবল প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেই পাওয়া সম্ভব, নাকি জনগণের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক থেকেও এই বৈধতা পাওয়া সম্ভব। সুশাসন, সীমিত দুর্নীতি, উন্নততর সরকারি সেবা—এসব থেকে কি বৈধতা পাওয়া সম্ভব নয়?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে তেমনভাবে জড়িয়ে পড়েনি, ছোটখাটো দু-একটি ঘটনা ছাড়া। কিন্তু বাংলাদেশ এখন বিবদমান বড় শক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণতি হতে যাচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, এটা কি বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে না।
বিনায়ক সেনের প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বৈধতার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না, এটা অনুভব করার বিষয়। (সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) লি কুয়ান ইউর বৈধতা ছিল। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে এক রকম ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনকার উন্নয়নশীল দেশগুলো কমিউনিস্ট দেশগুলোকে আর অনুসরণ করতে চায় না। মালয়েশিয়ার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) মাহাথির মোহাম্মদের প্রতি জনসমর্থন ছিল, এমনকি নির্বাচন না হলেও তা থাকত বলে মনে হয়। এসব মডেল থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে বলে মত দেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ভিয়েতনাম ও চীনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিয়েতনামের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর সেগুলো বেসরকারীকরণ করা হলেও সেখানে সরকারের হাতে কিছু শেয়ার আছে। এখন সেগুলো লাভজনক হওয়ায় সরকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে লভ্যাংশ পাচ্ছে, চীনেও তা–ই হচ্ছে। কিন্তু আলিবাবার জ্যাক মা যখন বেশি বেড়ে গেলেন, তখন ঠিকই তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হলো। অর্থাৎ, এরা হাইপার ক্যাপিটালিজম অনুমোদন করেনি।
ভিয়েতনামে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করা সম্ভব না হলেও অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে করা যায়, এমনকি সরকার তা গ্রহণও করে বলে উল্লেখ করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আছে, পার্টির ভেতরে, বাইরে—সবখানেই। বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার সময় এসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক নৈপুণ্যভিত্তিক কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামের রাজনীতি বিরক্তিকর হলেও আমলাতন্ত্র কৌতূহলোদ্দীপক, পশ্চিমা দেশগুলো ঠিক তার বিপরীত। এই অর্থনীতিবিদের মত, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো দুই মডেল থেকেই কিছু কিছু গ্রহণ করতে পারে। পরাশক্তিদের বিবাদ সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যে দ্বৈরথ চলছে, তা স্নায়ুযুদ্ধ থেকে অনেকটাই ভিন্ন। কারণ, এখন একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এত দিন ধরে শুল্ক–যুদ্ধ চালালেও এখন পর্যন্ত তারা পরস্পরের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। স্নায়ুযুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তি ছিল, বিষয়টি একদম সোজাসাপটা ছিল। চীন–যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি সে রকম নয়, যদিও চীন নিজেদের মডেল সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। সেটা আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। চীন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
ইদানীং নিজের লেখায় বাংলাদেশ শব্দটা উল্লেখ করেন না ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর ভাষ্য, অনেকেই বলেন, ‘আপনি কি বাংলাদেশের ভালো কিছু দেখেন না’। সে জন্য এখন তিনি ‘স্বল্পোন্নত’ বা ‘উন্নয়নশীল দেশ’ শব্দ উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ নয়।