সিডনি ওয়ালেস একজন কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদি সমাজকর্মী। তিনি কখনোই ইসরাইল যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। যদিও শিকাগোতে তার এলাকার সিনাগগে ‘নেক্সট ইয়ার ইন জেরুসালেম’ গানটি নিয়মিত গাওয়া হয়। ৩৯ বছর বয়সী ওয়ালেস জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সমাজে কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মনোভাব নিরসন এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ দূর করা নিয়ে প্রায়ই বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমি এখানে কিসের বিরুদ্ধে লড়ছি।’
সবকিছু বদলে গেল যখন তিনি একজন ফিলিস্তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্মী এবং কিছু যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম, ইহুদি এবং খৃস্টান ধর্মীয় নেতার আমন্ত্রণে ইসরাইল এবং পশ্চিম তীর পরিদর্শন করেন।
সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া ওই সফরের ফলে ইসরাইলি সামরিক দখলে থাকা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে ওয়ালেসের সম্যক ধারণা তৈরি হয়। ইসরাইলে ৭ অক্টোবর হামাসের অভূতপূর্ব হামলার ফলে তার সফর বিঘিœত হয়। এরপর গাজা ভূখ-ে ইসরাইলের বোমাবর্ষণ, ধ্বংস এবং মৃত্যুর ভয়াবহ চিত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বময় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্যাতন
ওয়ালেস এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সাথে জাতিগত সাম্য এবং নাগরিক অধিকারের জন্য তাদের নিজেদের সংগ্রামের মিল খুঁজে পান।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ কৃষ্ণাঙ্গ এবং ফিলিস্তিনি কর্মীদের অভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু এই ঐক্য মাঝে মাঝে কৃষ্ণাঙ্গ এবং ইহুদি কর্মীদের মধ্যে এক শতকের বেশি সময় ধরে বিদ্যমান বন্ধনে টানাপোড়েন তৈরি করে। কিছু যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি উদ্বিগ্ন যে ওই সমর্থন ইহুদি-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি এবং ইহুদি-কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধনকে দুর্বল করতে পারে।
জিউয়িশ কমিউনিটি রিলেশনস কাউন্সিল অফ নিউ ইয়র্কের দ্য সেন্টার ফর শেয়ারড সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক বব কাপলান বলেন, ‘ইসরাইল কী এবং ৭ অক্টোবরের হামলা আমাদের কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝার ক্ষেত্রে অভাব রয়েছে বলে আমরা একটি সম্প্রদায় হিসেবে মনে করি।’
তিনি মনে করেন, ইহুদি-বিরোধী মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের জন্য ততটাই বাস্তব এবং ভীতিকর, যতটা ভীতিকর বর্ণবাদ কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের জন্য।
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইহুদি এটা বোঝে যে কেন মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পান। তবে তা ইসরাইলের প্রতি তাদের সহানুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
এপি এবং এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চের চলতি মাসের শুরুর দিকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক কৃষ্ণাঙ্গদের ৪৪ শতাংশ মনে করে যে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত সমর্থন দেয়। কিন্তু এ ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গ এবং হিসপ্যানিকদের মধ্যে যথাক্রমে ৩০ ও ২৮ শতাংশ একই ধারণা পোষণ করে।
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা এই দুই সম্প্রদায়ের আন্দোলনকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় হামাস বেশ কয়েকজন পণবন্দীকে মুক্তি দেয়, বিনিময়ে ইসরাইল কয়েক শ’ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়।
জাতিগত বৈষম্য: কিছু যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ এই ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি পর্যবেক্ষণ করে, তারা ইসরাইল প্রশাসনের আটক-নীতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন যে বিচার ছাড়াই অনেক ফিলিস্তিনিকে বন্দী রাখা হয়।
তারা জাতিগত এই বৈষম্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারের নীতির তুলনা করছে। শিকাগোর দক্ষিণা লের একজন ফিলিস্তিনি-মার্কিন সমাজকর্মী রামি নাশাশিবি ‘ব্ল্যাক জেরুসালেম’ নামে ওই সফরে যাওয়ার জন্য ওয়ালেস এবং আরো কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানান।
নাশাশিবি বলেন, ‘আমার ফিলিস্তিনি পরিচয় অনেকটাই তৈরি এবং প্রভাবিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসের মাধ্যমে। আমি সবসময় আশা করেছি, এর ফলে নতুন রাস্তা তৈরি হবে যা শুধু রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত নয়, বরং মানবতার মুক্তির সংগ্রামের ক্ষেত্রেও যোগসূত্র তৈরি করবে, যা যুক্তরাষ্ট্রে অতি পরিচিত।
ওয়ালেস ওই সফরকালে ইসরাইলি দখলদারিত্বে থাকা ফিলিস্তিনিদের বাস্তবতা সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতা আবিষ্কার করে ক্ষুণ্ন বোধ করেছেন। ওয়ালেস দেখেছেন, ইসরাইলি চেকপয়েন্টগুলোতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয়। তিনি তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের জাতিগত বৈষম্যের মিল খুঁজে পান।
তিনি বলেন, ‘সেখানে গিয়ে আমি ভেবেছি জিম-ক্রো আমলে (যুক্তরাষ্ট্রে) বসবাস এমনটাই ছিল কিনা।’
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ এবং ফিলিস্তিনিদের ঐক্য বেড়েছে।
এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু পশ্চিম তীরের চিত্র মনে করিয়ে দেয়। ওই তুলনাকে মাথায় রেখে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের সাথে সীমান্ত বেষ্টনিতে আঁকেন জর্জ ফ্লয়েডের বিশাল এক ছবি।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার: ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-কর্মীরা যখন ২০১৬ সালে মুভমেন্ট ফর ব্ল্যাক লাইভস নামে কোয়ালিশন গঠন করেন, তখন ‘ভিশন ফর ব্ল্যাক লাইভস’ প্ল্যাটফর্মে তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। কিছু ইহুদি গোষ্ঠী যারা বিএলএমের পক্ষে ছিল, তারা কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদের ইসরাইলকে কথিত ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রায়িত করাকে নিন্দা জানায়।
‘ব্ল্যাক জেরুসালেম’ সফরের সদস্যরা কেউ অনুমান করতে পারেনি যে ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার কারণে তাদের সফর হঠাৎ বিঘিœত হবে। ওই হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত এবং প্রায় ২৪০ জন পণবন্দী হয়।
এরপর গাজায় ইসরাইলের প্রবল বিমান এবং স্থল অভিযানে ১৮ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ এখন তৃতীয় মাসে পড়েছে। পশ্চিম তীরেও সহিংসতা বেড়েছে।
শিকাগোতে ফিরে এসে ওয়ালেস ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সমর্থনের কথা বলছেন, একইসাথে নিজের ইহুদি পরিচয় এবং ইহুদি-বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান বজায় রেখেছেন।
তিনি বলেন, এই দুটি একসাথে থাকতে পারবে না এমনটি তিনি মনে করেন না।
তিনি বলেন, ‘আমি এমন কিছু না করার চেষ্টা করছি যা কাউকে দূরে ঠেলে দেবে। ভয়ের কারণে আমি ঠিক কাজটি করব না সেটি হবে না।’ সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা