চলছে বিজয়ের মাস। আর, বিজয়ের মাসেই মৌলভীবাজারে বয়কট হয়ে আছেন হিন্দু দুই শহীদের নিরীহ উত্তরসূরী। ফলে, নিরাপত্তহীনতা অনুভব করে নিরীহ এ হিন্দু পরিবারটি গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মৌলভীবাজার শহরে। ঘটনাটি চলমান রয়েছে মৌলভীবাজার শহরতলীর ঘড়–য়া গ্রামে। বেআইনীভাবে গ্রামের ‘পন্ডিত বাড়ী’ এর এজমালী ভূমি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দান করার অভিযোগে উক্ত ভূ-সম্পদের এক শরিকান স্বত্ব বাটোয়ারা মামলা দায়ের করেছেন দাতা শরিকানের বিরুদ্ধে। আর, এ মামলা দায়েরের কারণে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার এর পক্ষ নিয়ে দাতা শরিকানের পাওয়ার অব এঁটর্নী আনোয়ার ইকবালের আয়োজনে একাধিক বৈঠক করে মামলার বাদী মা ও ছেলেকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। জানা গেছে- ঘড়–য়া মৌজাস্থিত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দানকৃত ভূমিসহ বিপুল পরিমান ভূ-সম্পদের মালিক ছিলেন ঘড়–য়া গ্রামের ৩ ভাই পন্ডিত কৈলাস চরণ দাশ, পন্ডিত সারদা চরন দাস ও পন্ডিত অন্নদা চরন দাশ। পন্ডিত কৈলাস চরণ দাশ স্বাধীনতার অনেক আগেই স্বর্গীয় হন। অপর ২ ভাই পন্ডিত সারদা চরন দাস ও পন্ডিত অন্নদা চরন দাশ দুজনই ছিলেন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাদীক্ষা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রসহ নানা বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানসস্পন্ন। শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় ভূমিকা ইত্যাদির সুবাদে তাদের ৯ সদস্যের পরিবারের বসতবাড়ীটি তাদের জীবদ্দশা থেকে আজও ‘পন্ডিত বাড়ী’ নামে পরিচিত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকারদের তৎপড়তায় পাক হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন এ দুইভাই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে ধর্মীয় রীতিতে সৎকারের সুযোগও জোটেনি তাদের। পন্ডিত ভ্রাতৃত্রয়ের প্রতিষ্ঠিত শ্মশানেও গ্রামবাসী তাদের শেষকৃত্যনুষ্ঠান করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে গ্রামের হিন্দু-মুসলীম মিলে সারদা চরন দাস ও পন্ডিত অন্নদা চরন দাশের মৃতদেহ চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে মনু নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পিছু ছাড়েনি তাদের। তাই তো স্থানীয় শহীদদের তালিকায়ও স্থান হয়নি এ দুই শহীদের। এ শহীদদের ত্যাজ্যবিত্তের সকল ভূ-সম্পদ তাদের জীবদ্দশা থেকে এখন পর্যন্ত এজমালী রয়েছে। ইতিপূর্বে এ এজমালী বিপুল পরিমান ভূ-সম্পদ বিক্রি করে দেন তাদের এক উত্তরসুরী কানাডা প্রবাসী ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশ। সর্বশেষ- ১.২৭ একর এজমালী ভূমি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার-কে দান করে দেন। এ কারণে উক্ত ভূ-সম্পদের অপর শরিকান তার স্বর্গীয় ভাইয়ের স্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষক (অবঃ) কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পুত্র পংকজ দাশগুপ্ত মৌলভীবাজার সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ব বাটোয়ারা মামলা (নং-০৬/২০২৩ইং) দায়ের করেন। এ মামলা দায়েরের কারণে ডাঃ সুধেন্দু বিকাশ দাশের পাওয়ার অব এটর্নী আনোয়ার ইকবাল গ্রামবাসী নুরুল ইসলাম কামরান, দুরুদ মিয়া, সাচ্চু মিয়া, হুমায়ুন আহমদ, ইমন মিয়া, জুবায়ের আহমদ, নির্মল কান্তি দেব, রিপন দেব প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত লোকজনকে ভুল বুঝিয়ে মামলার বাদী কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পংকজ দাশগুপ্তকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। ফলে, এলাকায় নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে প্রাথমিক শিক্ষক (অবঃ) কল্যাণী দাশগুপ্ত ও পংকজ দাশগুপ্ত গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এভাবেই বিজয়ের মাসেও বয়কট ও গ্রামছাড়া হয়ে আছেন দুই শহীদের নিরীহ উত্তরসূরী। এ ব্যাপারে সম্প্রীতি বাংলাদেশ মৌলভীবাজার জেলা শাখার সদস্য সচিব সৌমিত্র দেব বলেন- হার্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত বেশীরভাগ সদস্যই সমাজের সম্মানিত মানুষ। মামলা করার কারণে তারা কাউকে একঘরে করলে বা সামাজিক ভাবে বয়কটের চেষ্টা করলে বিষয়টি খুব দুঃখজনক হবে। একুশ শতকের পৃথিবীতে এ ধরণের ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। এটা আমাদের সংবিধান ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত। আমি জানিনা তারা কি করে এমন কাজ করতে পারলেন। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আশাকরি অচিরেই তাদের মনে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছালেহ আহমদ সেলিম বলেন-এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকলে নিঃন্দেহে তা দুঃখজনক, নিন্দাজনক ও মানবাধিকার লংঘন। আমরা ঘটনাটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রযোজন হলে পরিবারটির পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করবো।