যাপিত জীবনে পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, যা মহান আল্লাহর অপার নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত। আর বন্ধু মানে জীবন চলার বাঁকে বাঁকে নানা বিষয় ও কাজের সহযোগী। এই সহযোগী বা বন্ধু নির্বাচনে আছে, ইসলামের শক্ত নীতিমালা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, যাকে তাকেই বন্ধু বা সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না; বরং বন্ধু সে হবে, যে কল্যাণকর কাজের সহযোগী হবে এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ানোর ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করবে। অতএব, বন্ধু হবে পরকালের কল্যাণে। এর বিপরীতে যে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং কল্যাণকর কাছ থেকে বিরত রাখে, এমন সব লোকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্বে জড়ানো সঠিক নয়। কুরআন ও হাদিসে এমন চার শ্রেণীর কথা উল্লেখ আছে, যাদের সাথে বন্ধুত্ব সঠিক নয়।
কাফির : এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘মু’মিনরা যেন মু’মিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে (নিজেদের) মিত্র না বানায়। যে এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনো পন্থা অবলম্বন করে, সেটি ভিন্ন কথা।’ (সূরা আলে ইমরান-২৮) আয়াতে বর্ণিত ওলি বা মিত্র দ্বারা এমন বন্ধুত্ব ও আন্তরিক ভালোবাসাকে বুঝানো হয়েছ, যার দ্বারা দু’জন লোকের জীবনের লক্ষ্য ও লাভ-লোকসান অভিন্ন হয়ে যায়। মুসলিমদের এ জাতীয় সম্পর্ক কেবল মুসলিমদের সাথেই হতে পারে। অমুসলিমদের সাথে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন পাপ। ওপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- ‘হে মু’মিনরা! মুসলিমদের ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধু বানিয়ো না। তোমরা কি আল্লাহর কাছে নিজেদের বিরুদ্ধে (নিজেদের শাস্তিযোগ্য হওয়া সম্পর্কে) সুস্পষ্ট প্রমাণ দাঁড় করাতে চাও?’ (সূরা নিসা-১৪৪)
জালিম বা অত্যাচারী : এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালেম।’(সূরা মুমতাহিনা-৯) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অত্যাচারীকে অত্যাচারী হিসেবে জানার পরও তাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য তার সাথে চলে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল।’ (তাবরানি-১/৩২)
ফাসেক : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘হে মু’মিনরা! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।’ (সূরা হুজরাত-৬) উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা গেল, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনো ফাসেক ব্যক্তির সংবাদের ওপরও আস্থা রাখা উচিত নয়, সেখানে কিভাবে একজন ব্যক্তি ফাসেকের সাথে সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থাপন করা যায়!
তা ছাড়া এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর দিনের ওপর হয়, অতএব, তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে।’ (তিরমিজি-২৩৭৮)
বোঝা গেল, কেউ যদি ফাসেক, তথা পাপাচার, গুনাহগার ও মিথ্যুক ব্যক্তির সাথে ওঠাবসা, চলাফেরা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তাহলে তার মধ্যেও ওই ব্যক্তির মন্দ গুণাগুণ চলে আসবে।
বিদয়াতি : শরিয়তের পরিভাষায় বিদয়াত বলা হয়, যে জিনিস বা কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি, সেই ধরনের জিনিস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তা সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে করা। রাসূলুল্লাহ সা: বিদয়াতের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং তার নানাবিধ খারাপ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন।
বিদয়াতের একটি নিকৃষ্ট পরিণাম হলো, ‘কিয়ামতের দিন সে রাসূল সা:-এর সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে। নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের জন্য আমার সুপারিশ থাকবে, তবে বিদয়াতিরা সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে।’ (আল-বিদউ ওয়ান-নাহিউ আনহা-৮৫)
অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা: যেমনিভাবে বিদয়াতের অনুসরণ নিষেধ করেছেন, তেমনিভাবে বিদয়াতিকে কোনো প্রকার সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন, ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বিদয়াতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, সে যেন ইসলাম ধ্বংস করার কাজে সাহায্য করল।’ (তাবরানি-৭৬৭২) উপর্যুক্ত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, বিদয়াতি সে যেই হোক, আলেম হোক বা আলেম না হোক, সে কোনো প্রকার সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। কারণ সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন, বিদয়াত প্রবর্তনকারী মূলত ইসলামের পরিপূর্ণতাকে অস্বীকারকারী। ইমাম মালেক রা:-এর একটি কথা থেকে তা প্রমাণ হয়, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো বিদয়াতের প্রচলন ঘটাল আর একে নেককাজ বলে মনে করল সে যেন প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করল যে, মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে খিয়ানত করেছেন।’ (নাউজুবিল্লাহ) কারণ যেখানে আল্লাহ তায়ালা নিজে ইরশাদ করেছেন- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম’। (সূরা মায়িদা-৩) সুতরাং রাসূল সা:-এর যুগে যে আমল দ্বীন হিসেবে গণ্য ছিল না তা আজো দ্বীন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। অতএব, এ ধরনের দ্বীনবিরোধী ইসলামবিদ্বেষী ও ইসলামকে বিকৃত সাধনকারী ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের কোনো প্রশ্নই আসে না?
তাই আসুন! আমরা আমাদের যাপিত জীবনে এই চার শ্রেণীর সাথে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে জড়ানো থেকে নিজেকে দূরে রাখি। লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলুম মাদরাসা, মধুপুর, টাঙ্গাইল