সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০২ অপরাহ্ন

‘ভোট কারচুপি’র কথা বলছেন নৌকার পরাজিত প্রার্থীরাও

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪

আওয়ামী লীগ, দলীয় স্বতন্ত্র, শরিক ও মিত্র দলের প্রার্থীদের পাশাপাশি ‘কিংস পার্টি’ও ভোটে কারচুপির অভিযোগ করছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ভোটের পরপর শেষ বেলায় প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারাসহ কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থীদের অনেকে। এঁদের মধ্যে কেবল জাতীয় পার্টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নতুন দলগুলো নয়; আওয়ামী লীগের প্রার্থীও রয়েছেন।
৭ জানুয়ারি ভোটের দিন থেকেই বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলতে শুরু করেন। নির্বাচনের দিন থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত আওয়ামী লীগের, স্বতন্ত্র, নৌকা প্রতীকে ভোট করা শরিক দল ও জাতীয় পার্টির (জাপা) অন্তত ২৫ জন প্রার্থী এরই মধ্যে নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। এঁদের মধ্যে ৪ জন আওয়ামী লীগের, ২ জন শরিক দলের (নৌকা প্রতীকের), ১৫ জন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র। বাকিরা অন্য দলের। ইতিমধ্যে কয়েকজন প্রার্থী অনিয়ম-কারচুপির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনেও (ইসি) লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী ভোটের ফলাফলের গেজেট হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু থাকে না। কোনো প্রার্থীর অভিযোগ থাকলে তিনি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বা আদালতে যেতে পারেন।
ভোটের দুই দিন পর মাদারীপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আবদুস সোবহান অভিযোগ করেন, সূক্ষ্ম কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি হেরেছেন। বিশেষ করে কালকিনি পৌরসভার ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি কেন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা দখলে নিয়ে ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি করেছেন।
নৌকার প্রার্থীদের যত অভিযোগ: ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন (নৌকা প্রতীক) সানজিদা খানম। আসনটির ১৮টি কেন্দ্রে ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ৭ জানুয়ারি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এবং ৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর পৃথক আবেদন দেন সানজিদা খানম। এরপর গত মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ওই আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আওলাদ হোসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব।
মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগম (ঈগল)। তাহমিনা কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ভোটের দুই দিন পর মাদারীপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আবদুস সোবহান অভিযোগ করেন, সূক্ষ্ম কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি হেরেছেন। বিশেষ করে কালকিনি পৌরসভার ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি কেন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা দখলে নিয়ে ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি করেছেন। নির্বাচনের দুই দিন পর গত মঙ্গলবার দলের কর্মিসভায় মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, কয়েকটি কেন্দ্রে কারচুপি করে তাঁকে হারানো হয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের ভোটও ট্রাক প্রতীকে পড়েছে।
ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বরগুনা-১ আসন থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বরগুনা আওয়ামী লীগের চার নেতার মধ্যে ভোটে তৃতীয় হয়েছেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ।
ভোটের ফলাফলে অনিয়মের বিষয়ে গত মঙ্গলবার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ। তাতে বলা হয়, বেআইনিভাবে ভোট গণনা, ফলাফল বিবরণী প্রস্তুত ও একত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় নৌকা প্রতীকের উপস্থিত এজেন্টদের জোর আপত্তি উপেক্ষা করা হয়েছে। আইনসংগতভাবে প্রস্তুত না করায় ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপ হয়েছে।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থী মমতাজ বেগম হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদের (প্রতীক ট্রাক) কাছে। নির্বাচনের দুই দিন পর গত মঙ্গলবার দলের কর্মিসভায় মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, কয়েকটি কেন্দ্রে কারচুপি করে তাঁকে হারানো হয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের ভোটও ট্রাক প্রতীকে পড়েছে।
পাবনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল হামিদ কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপিসহ অনিয়মের নানা অভিযোগ করেছেন।
স্বতন্ত্রদের অভিযোগ বেশি: আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, এজেন্ট বের করে দেওয়া, জাল ভোটসহ নানা অভিযোগ করেছেন রাজবাড়ী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরে আলম সিদ্দিকী হক। তিনি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি ফলাফল বাতিল করে পুনর্র্নিবাচনের দাবিতে গত মঙ্গলবার ইসিতে আবেদন করেন। কুষ্টিয়া-৩ আসনে কারচুপির অভিযোগ এনে গেজেট বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ারের কর্মী-সমর্থকেরা। পারভেজ আনোয়ারের বাবা কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়, ভোটের দিন বেলা একটার মধ্যে অধিকাংশ কেন্দ্র দখলে নেন নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা। এরপর খবর আসতে থাকে, নৌকায় সিল মারা হচ্ছে।
পাবনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল হামিদ কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপিসহ অনিয়মের নানা অভিযোগ করেছেন। একই রকম অভিযোগ তুলে কয়েকটি কেন্দ্রে নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানান ফরিদপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন।
অভিযোগ তুলছেন শরিকেরাও: জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ইনু অভিযোগ করেন, জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে তাঁকে হারানো হয়েছে। রাজশাহী-২ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। হুমকি ও ভয়ভীতির কারণে ভোটাররা নির্ভয়ে ও নির্বিঘেœ ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেননি উল্লেখ করে ইসিতে লিখিত অভিযোগ করেন বাদশা। একই রকম অভিযোগ তুলে কয়েকটি কেন্দ্রে নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানান ফরিদপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন।
জাপাও বলছে কারচুপি হয়েছে: গাইবান্ধা-১ আসনের দুবারের সংসদ সদস্য জাপার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ২৬ হাজার ভোটের ব্যবধানের হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। শামীম হায়দার অভিযোগ করেছেন, সারা দিন ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও যে কাস্টিং (প্রদত্ত ভোট) দেখানো হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে ভোটে কারচুপি হয়েছে।
ভোটের পরদিন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ৭ জানুয়ারি ‘সঠিক’ নির্বাচন হয়নি। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন ছিল। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই হয়েছে।
‘কারচুপির উৎসব’ বলছে অন্য দলও : তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। তিনি নির্বাচনকে ‘সাজানো’ বলে আখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন হইছে সরকার বনাম সরকার, নৌকাও সরকারের, স্বতন্ত্রও সরকারের। মনে হচ্ছে দেশটা একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘ভোট কারচুপির উৎসব’ বলেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর ও মহাসচিব মো. শাহজাহান অভিযোগ করেন, ভোটের দিন সকাল থেকে ব্যালট কেটে বাক্স ভরা শুরু হয়। ফলে ভোটারদের অংশগ্রহণ না থাকলেও গণনায় বিশেষ দলের দলীয় বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে এগিয়ে ছিলেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com