অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, আমরা জাতিগতভাবে ইতিহাসমনষ্ক নই। চরিত্র বিনির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। আবেগের ভেলায় ভেসে ‘প্রশংসাকে পূজায় এবং সমালোচনাকে ‘কুৎসায়’ পরিণত করি। এর কারণ বাঙালি মন মায়াজালে আবদ্ধ। সঙ্গতকারণে আমার পক্ষে এই জাতির ইতিহাস চর্চার পরিচিত মসৃণ পথের বিপরীতে গিয়ে হঠাৎ করে ইতিহাসমনষ্ক হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। এই অক্ষমতা মাথায় রেখেই যা কিছু দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে সমর্থিত এমন কয়েকটি বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে রণাঙ্গনের জিয়া ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রবর্তনে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের সাফল্য মূল্যায়নের চেষ্টা করব।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের বীরত্বগাথা ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তার চরিত্র উপলব্ধি করতে হলে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ ও স্বরূপ, পঁচাত্তরের পরের দিশেহারা রাজনীতির প্রেক্ষাপটের বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল, এ কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। রাজনৈতিক বিভাজন তখনো ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ফেরত এসে যুদ্ধে যোগ দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়হীনতা ছিল। অন্য দিকে থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব ছিল প্রায় দৃশ্যমান। (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি : সময়-অসময়, ২০০৭ পৃষ্ঠা-১৫)। ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই ভিন্নতা রাজনৈতিক মোড় নেয়, জন্ম ও বিকাশ লাভ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। সাধারণত এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের মাঠে, গোলটেবিল আলোচনায় কিংবা ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা নেতাদের উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। সেই বিবেচনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির জন্ম এবং জনপ্রিয়তা এ অঞ্চলে রাজনৈতিক দল গঠন ও প্রতিষ্ঠা লাভের দিক থেকে বিরল ঘটনা। পেশাদারিত্ব জিয়াউর রহমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান দিক। সৈনিক জিয়া ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন ‘আলফা কোম্পানির’ কমান্ডার হিসেবে ‘খেমকারান’ রণাঙ্গনের বেদিয়ানে যুদ্ধে অংশ নেন। এ যুদ্ধে সাহসিকতা ও কৃতিত্বের জন্য তার কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৯ সালে মেজর জিয়া দেশে ফিরে আসেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পার না হতেই পরিস্থিতি বিস্ফোরোন্মুখ হয়ে ওঠে। আসে ২৫ মার্চের কাল রাত। বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশুসন্তানকে চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই মেজর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থার অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে; লাখো মা-বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা নিয়ে তার কঠোর সমালোচকরাও নিন্দার কোনো আলামত বা উপকরণ খুঁজে পাননি। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত হয়ে তাদের লেখায় জিয়ার প্রশংসা করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (আমার একাত্তর), ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত, ট্রেভর ফিসলক ও ডেভিড লুডেন (মাহফুজউল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ, এডর্ন পাবলিকেশন-২০১৬)। জিয়াই হলেন বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যার ছবি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম মিউজিয়ামে অমর কীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত।
এর ব্যতিক্রমও আছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থে (রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ১৯৭৪, লাখো প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা) স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং জিয়ার অবদানের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। এতে অবাক হওয়ারও তেমন কিছু নেই। কারণে চরিত্র বিনির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা তাকে অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। তিনি হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাননি। ১৯৭৪ সালে তার নিজের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধে এর আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। অবশ্য গুটিকয়েক দালাল ছাড়া আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখত, অবহেলা করত, অসম্মান করত। দক্ষ ও যোগ্য বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের ভাগ্যে জুটত না কোনো স্বীকৃতি বা পারিতোষিক। জুটত শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা… ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল…’ (রহমান, মেজর জেনারেল জিয়াউর (১৯৭৪), একটি জাতির জন্ম, বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যা, ২৬ মার্চ-১৯৭৪, ঢাকা)।
অন্তরে পুষে রাখা স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৬ মার্চ তার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার আব্দুর রশিদ জাঞ্জুয়াকে প্রতিহত করেন। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যের রাতে জিয়া চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে বলেন, ইস্ট বেঙ্গলের অষ্টম ব্যাটেলিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া যে তার সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, সেটি তার সহকর্মীরা সমর্থন করেন এবং পরে ২৭ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি : সময়-অসময়, ২০১৭, পৃষ্ঠা-৪৬)।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়ার রণকৌশল প্রয়োগের বিষয়টি খুব একটা বাধামুক্ত ছিল না। চিহ্নিত শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা জিয়াসহ রণাঙ্গনের অনেক যোদ্ধার উৎসাহ-উদ্দীপনাকে স্তিমিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। পদ ও বয়সের কারণে তার নিযুক্তি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু তিনি সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান তার শুভ দৃষ্টিবঞ্চিত ছিলেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করা কর্মকর্তাদের ওপর। বীরত্বসূচক পদক বিতরণের সময় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পদকবঞ্চিত হন জিয়ার অধীনে যুদ্ধ করা বেশির ভাগ কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে, অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেই এম এ জি ওসমানীর সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ‘খয়রাতি বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন (কর্নেল শাফায়াত জামিল-২০০৯, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৫৪)।
রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জিয়াকেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক ঘটে তখনই, যখন দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জিয়া ও সফিউল্লাহ একই ব্যাচে কমিশন পেলেও ক্রম অনুযায়ী জিয়ার নাম উপরে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়। এখানেই শেষ নয়। সফিউল্লাহকে প্রথম মেয়াদ শেষে দ্বিতীয়বারের মতো সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় (নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ১৫ আগস্টের হত্যাকা- : ঘটনার আগে-ঘটনার পরে, ভোরের কাগজ, ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট, ১৯৯৪)।
ইতিহাসের এই বিবরণ পাঠে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয় : কর্মজীবনের শুরু থেকেই রণাঙ্গনে ভূমিকা রাখার জন্য পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কারে ভূষিত জিয়াউর রহমানের সাথে এম এ জি ওসমানীর এই শীতল সম্পর্কের কারণ কী? কেনই বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রচলিত জ্যেষ্ঠতার নিয়ম লঙ্ঘন করে, মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় অবদান রাখার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তম জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার পদবঞ্চিত করা হলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার যথাযথ ব্যক্তিরা হলেন ইতিহাসের গবেষকরা। আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে বিরত থাকাই সঙ্গত মনে করছি।
পেশাদার একজন সামরিক কর্মকর্তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদে যাওয়ার বিষয়টি তার অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এটি মোহ বা লোভের বিষয় নয়। অধিকার বঞ্চিত হয়েও প্রতিশোধের পথ বেছে না নিয়ে তিনি বছরের পর বছর (অন্তত সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে সফিউল্লাহর ৩+৩=৬ বছর মেয়াদে) ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। লে. কর্নেল অব. এম এ হামিদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দিতে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়। পেশার প্রতি একনিষ্ঠ জিয়া বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত খুরশিদ উদ্দিন আহম্মেদের সহায়তায় দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার দুর্ভাগ্যবরণ করা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন (হামিদ, লে. কর্নেল অব: এম এ-২০১৩, তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ১২-১৩)। ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পেছনে জিয়াউর রহমানকে অনেকেই অনুমাননির্ভর মূল্যায়ন করে থাকেন। দু’টি ঘটনা উল্লেখ করে বলা যায়, পটপরিবর্তনের কর্মকা-ে তার সম্পৃক্ততা ছিল না।
১. প্রথম ঘটনাটি হলো, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পরে ওই বিষয়ে অবহিত করার পরও জিয়ার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার কোনো ধরনের লক্ষণ কিংবা আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি; বরং অতি সংক্ষেপে বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষেই তিনি মতপ্রকাশ করেন (কর্নেল শাফায়াত জামিল-২০০৯, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১০৩)।
২. দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, সাফায়াত জামিল জিয়ার কক্ষে বসে আছেন। এমন সময় সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এবং সরকারি আদেশে দিল্লিতে অবস্থানরত মেজর জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের কক্ষে প্রবেশ করেন। এরশাদকে দেখে জিয়াউর রহমান রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বলেন, ‘আপনি অনুমতি ছাড়া কেন দেশে ফিরে এসেছেন?’ জবাবে এরশাদ বলেন, ‘আমার স্ত্রীর জন্য গৃহভৃত্য নিতে এসেছি’। ততোধিক রেগে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এ ধরনের লাগামহীন আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে।’ (কর্নেল সাফায়াত জামিল-২০০৯, পৃষ্ঠা: ১২০-১২১)।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশঙ্কাজনকভাবে সঙ্কুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকা-ে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই আদেশে বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কারো বিচার করা যাবে না। (মহিউদ্দিন আহমদ, ২০১৭, পৃষ্ঠ-৬৪) অধিকন্তু কর্নেল সাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী, তার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও খোন্দকার মোশতাক অভ্যুত্থান ও হত্যাকা-ে জড়িত মেজর রশীদ, ফারুক ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন (সাফায়াত জামিল, ২০০৯, পৃষ্ঠা-৭)। এ ঘটনা প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অভ্যুত্থানকারীরা ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকা-ে সংঘটিত করল? অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো তৎকালীন সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক মনস্তত্ত্ব। স্পষ্ট ভাষায় বললে, তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রতি অবহেলা ও ভারতীয় আধিপত্যের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯৭৪ সালে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করার বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না।’ (মাসকারেনহাস, অ্যান্থনি-২০০২), বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, অ খধমধপু ড়ভ ইষড়ড়ফ-এর ভাষান্তর, অনুবাদ : মোহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানি পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৩৮-৩৯)। এর বিপরীতে তিনি রক্ষীবাহিনী নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেন; প্রথমে পুলিশের এটি সহায়ক বাহিনী হলেও পরে এই বাহিনীকে ক্ষমতা দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারত এবং অনেকেই মনে করেন তাদের ব্যবহার করা হতো আওয়ামী লীগের সমালোচকদের বিরুদ্ধে (প্রাগুক্ত)। এর সাথে যুক্ত হয় বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব অগ্রহণযোগ্য ছিল মর্মে মন্তব্য করেছিল আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত মিত্র বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি। তাদের মূল্যায়নে বলা হয়, ‘আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্ম ও ভিত্তি তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার মতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে… পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে তেমন বৈরীসুলভ দৃষ্টি গ্রহণ করা খুবই ক্ষতিকর হবে (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৯, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আমাদের পার্টির ভূমিকা ও করণীয়’, কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত, পৃষ্ঠা : ১৪-১৫)।
জিয়ার দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয় তা নয়; বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কী হবে, এর একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি গঠন করেছেন, যা পর্যায়ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
এই দলের গ্রহণযোগ্যতা তথা জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি কারণ হলো ১. জাতীয়তাবাদী দলের দার্শনিক ভিত্তি; ২. জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা ও ৩. কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ।
বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় ‘বাঙালি’ হিসেবে ধার্য করা হলেও জিয়াউর রহমান এই ধারণায় পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘বাঙালি’ পরিভাষাটি ব্যবহার করি, তাহলে বাংলাদেশ ভূখ-ে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকরা (যেমন-আদিবাসীরা) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে ‘বাঙালির’ স্থলে ‘বাংলাদেশী’ পরিভাষা ব্যবহার করা প্রস্তাব করেন।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ এই রাষ্ট্র দর্শনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে প্রান্তিক আদিবাসীরাও গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতি পায়, জিম্মি থাকে না। (আহমদ শরীফের ডায়েরি, ভাব-বুব্দুদ, পৃষ্ঠা-৬৪)।
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এক দিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্মবিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ আবার প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অধিকার নিশ্চিত করে। জিয়া সাংবিধানিকভাবে দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেননি। তিনি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযুক্ত করার মাধ্যমে মূলত রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি এক দিকে যেমন অমুসলিম নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় সমুন্নত রেখেছেন, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার প্রতি আন্তরিক সমর্থনের নিদর্শন হিসেবে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও নির্মোহ অকপট ভাবনায় অতুলনীয় প-িত আহমদ ছফা বলেন, ‘ইসলামের সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের সাথে যোগহীন রাজনীতির কোনো ভবিষ্যত এ দেশে নেই।’ (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন-১৯৮১)
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যতম কারণ জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদা। এই ভাবমর্যাদা তৈরির পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যতিক্রমী সততা ও সদগুণাবলির চর্চা। এ বিষয়ে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রেস সচিব কাফি খান, যিনি এক সময় ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক ছিলেন, বলেছেন, ‘আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তার বাসায় আসার সাহস পায়নি। তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সফরসঙ্গী হিসেবে। তা-ও সব সফরে নয়।… তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন। (সৈয়দ আবদাল আহমেদের নেয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, (িি.িনহঢ়নফ.ড়ৎম)।
একই ধরনের মূল্যায়ন করেছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতো স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমুক্ত এত কঠোর রাষ্ট্রনায়ক আমি আগে কখনো দেখিনি।’ (ভাসানীমঞ্চ, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন)
এই দলের গ্রহণযোগ্যতার পেছনে তৃতীয় কারণ হলো, কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। যে কথা বলে শেষ করতে চাই, তা হলো জিয়ার জাতীয়তাবাদী দর্শনের মর্মকথা হলো, কেবল ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের মতাদর্শের সঠিক উপলব্ধি ও এর বাস্তবায়ন। এই লক্ষ্য অর্জনে জিয়ার উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা ভূমিকা রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই। লেখক : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়