বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্যাস সংকট নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও কেন সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে বিদেশী কোম্পানিকে ইজারা দেয়া নিয়ে অসচেতনতার অভিযোগ উঠেছে। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে ১২ নম্বর সমুদ্র ব্লকটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। এটি পসকো দাইয়ুকে ইজারা দেয়া প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কারণ এই ব্লকের লাগোয়া অঞ্চল মিয়ানমার থেকে পসকো দাইয়ু অপারেটর হিসেবে গ্যাস উত্তোলন করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল যে পসকো দাইয়ু বাংলাদেশে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য এসেছিল নাকি এখানকার তথ্য নিতে এসেছিল, সেটি যাচাই করা প্রয়োজন ছিল। কারণ তাদের কর্মকা-ে এটিই অনুমেয় হয় যে তারা এখানে জরিপ করে তেল-গ্যাসের তথ্য জেনেছে। উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর চলে গেছে। এভাবে বিদেশী কোম্পানিকে জরিপের কাজ দেয়ার মাধ্যমে যে ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিও নতুন করে সামনে এসেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে (বাপেক্স) যেহেতু কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সে হিসেবে বিদেশী কোম্পানির দ্বারস্থ হওয়ার বিকল্পও তৈরি হয়নি।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এরই মধ্যে সরকার পিএসসির (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) অনুমোদন দিয়েছে। তবে অনুমোদনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। এক্ষেত্রে দেশে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে ‘মডেল পিএসসি ২০২৩’ অনুযায়ী এক্সনমবিলের মতো জায়ান্ট কোম্পানির প্রস্তাবের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এখনো সে প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কনকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা সাফল্যের মুখ দেখত বলে মত এসেছে। একদিকে দেশী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ঘাটতি, অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে ফলপ্রসূ চুক্তি না হলে গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশকে সুদীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে এমনটিই মত বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে তীব্রভাবে আর্থিক সংকটে পড়েছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কখনো গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, আবার কখনো আন্তর্জাতিক ঋণদাতার দ্বারস্থ হয়েছে। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা দেশে গ্যাস খাত দেনার দায়ে জর্জরিত হওয়ার পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে জ্বালানি অনুসন্ধানে বিমুখতা ও এলএনজির আমদানি বাড়ানোকে দায়ী করেছেন। অথচ এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুটি দেশ ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। তাই গ্যাস সংকটের অবসানে আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। প্রতিবেশী দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে আমাদেরও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে আরো বিলম্ব করলে জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা অধরাই থেকে যাবে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ের পর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রতিবেশী দেশ দুটি এক্ষেত্রে সাফল্য পেলেও বাংলাদেশ এখনো বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে। আবার বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা শক্তিশালী করার স্বার্থে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অতিদ্রুত সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
একটি সহযোগী জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ সূত্র বলছে, গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে চলতি বছরের শুরুতে বড় সাফল্য পেয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। গভীর সমুদ্রে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। এদিকে বঙ্গোপসাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতেরও আগে সাফল্যের দেখা পেয়েছে মিয়ানমার। এরই মধ্যে দেশটি কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে। নিজস্ব চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ গ্যাস তারা রফতানি করছে চীনেও।
প্রতিবেশী দেশগুলো সাফল্যের দেখা পেলেও বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এখনো অঙ্কুরেই রয়ে গেছে। বিগত সময়ে কয়েকটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু এসব কোম্পানি নিজস্ব বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করলেও পরে ব্লক ছেড়ে চলে গেছে। এরপর বিরাজমান গ্যাস সংকট মোকাবেলায় আমদানিনির্ভরতাকেই বেছে নেয় জ্বালানি বিভাগ, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে জ্বালানি নিরাপত্তা শক্তিশালী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে গণ্য হবে। বণিক বার্তায় আরেকটি প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দুটি ভাসমান টার্মিনালই অচল থাকায় দেশব্যাপী গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আমরা মনে করি, এই সঙ্কট সমাধানে নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়াতে হবে। আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বের বিবেচনা করেকার্যকর পদক্ষেপ নিবেন।