নরসিংদী জেলার শিল্পাঞ্চলখ্যাত মাধবদীর গরুরহাট ও বাসস্ট্যান্ড শ্রমবাজারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ভোর থেকে জটলা বেঁধে থাকেন দিনমজুররা। এখানে শ্রম বিক্রি করার জন্য শ্রম হাঠ বসলেও মিলছে না পর্যাপ্ত ক্রেতা। এই স্থানসহ আরও কয়েকটি স্থান থেকে দিনমজুরদের দৈনিক চুক্তিভিত্তিক কৃষিকাজ ও রাজমিস্ত্রীর কাজ সহ বিভিন্ন কাজে নিয়ে যান অনেকে। তবে বেশ কয়েকদিন থেকে তীব্র শীতের মাঝে তারা আর কাজ পাচ্ছেন না। মাধবদীর বিরামপুর এলাকা থেকে খুব ভোরে বাসস্ট্যান্ডে কাজের খুজে এসেছেন দিনমজুর নাসির। গত ৪ দিন তিনি কোনো কাজ পাচ্ছেন না। ভোর ছয়টায় এসে দুপুর ১২টার দিকে তিনি খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। তার কাজের রোজগারে প্রতিদিন চলে তার পুরো পরিবারের খরচ। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরবেলায় কাজের আশায় এখানে আসছি। ফজরের আগে এখানে এসে ছয়টায় পৌছাচ্ছি। দুপুর পর্যন্ত বসে থেকেও কেউ কাজে নিচ্ছে না। অন্য কোন কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে বাড়িতে আমার আশায় সবাই বসে থাকে। একটা কাজ পেলে হয়তো বাড়িতে চুলা জ্বলবে, নাহলে জ্বলবে না। শুধু রাজমিস্ত্রী নাসিরই নয়। তার মতো আরো শতাধিক দিনমজুর এই শীতে কাজ পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। দিনমজুররা প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য বসে থেকে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। তারা বলছেন, শীতের কারণে কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এসময় জমিতেও কাজ নেই। নরসিংদী ও মাধবদীতে কাজের শ্রমিক পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, মোটরসাইকেল বা যানবাহন থামলেই অথবা কোন ভদ্রলোক তাদের কাছে আসলেই দিনমজুররা সেখানে ভিড় করছেন।
কাজ পাওয়ার আশায় ছুটে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় হতাশা নিয়ে আবার ফিরে আসছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করছেন। মাধবদীর ম্যানচেস্টার চত্তরের পাশেই গরুর হাঠে প্রতিদিনই আসে অপু নামের একজন দিনমুজুর তিনি জানান, শীত শুরু হওয়ার পর তারা খুবই দুর্বিসহ জীবন পার করছেন। কাজ না পেয়ে গত আটদিন বাড়ি ফিরে গেছেন। আরেক শ্রমিক লোকমান আলী বলেন, দিন দিন আমাদের কাজের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। নরসিংদী ও মাধবদীতে অনেক পাওয়ারলোম বন্ধ হয়ে গেছে আর যেগুলো খোলা আছে তাও চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। এসব শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ায় বিপুলসংখ্যক পাওয়ারলোম শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। অনেকেই পাওয়ারলোমের শ্রমিকের কাজ হারিয়ে আজ দিনমুজুরের কাজে যোগ দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থেকে আসা হজরত আলী জানান, গত দশ বছর ধরে তিনি মাধবদীতে কাজ করছেন কিন্তু আগে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি কখনো। গত এক সপ্তাহে মাত্র দুইটি কাজ পেয়েছেন। সকাল ৮টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত দেখা যায়, প্রায় ২০০ দিনমজুরের মধ্যে মাত্র ২০/২৫ জনকে কাজে নেয়া হয়। বাকিরা বেলা পর্যন্ত বসে থেকে চলে যায়। নরসিংদীতে চলতি বছর শীত এসেছে দেরি করে। এই জানুয়ারি মাসের আগেও তেমন শীতের দাপট ছিল না। আগে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়েই মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কবলে থাকতো নরসিংদী। কিন্তু গেল প্রায় ৩-৪ বছর থেকে সেই অর্থে শীত পড়েনি। চলতি বছর তাও ১৩/১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নামতে দেখা গেছে। তবে এই শীতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নরসিংদীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা খুব নিচে না নামলেও রোদ না ওঠায় কম থাকছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসায় হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হচ্ছে। প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে বিকেলের আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর রোদ ওঠার কিছুক্ষণ পরই মেঘ বা কুয়াশায় তা ঢেকে যাচ্ছে। মেঘ এবং ঘনকুয়াশার মধ্যেই বইছে উত্তরের হিমেল হাওয়া। এতে শীতার্ত মানুষগুলো যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে নরসিংদী ও মাধবদীর পুর্বাঞ্চলের এলাকা, সাবেক রেললাইনের পাশের ঝুপড়ি ঘরে ও বিভিন্ন ফুটপাতের ওপর খোলা আকাশের নিচে থাকা ভাসমান মানুষগুলোর জীবন অসহনীয় এবং অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে। একদিকে শীতের কষ্ট, আরেক দিকে ক্ষুধার। কনকনে শীতের এই একেকটি দিন তাদের কাছে পাহাড়ের মতো হয়ে উঠেছে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে পথের ধারে খড়কুটো, প্লাস্টিক, টায়ার ইত্যাদি জ্বালিয়ে তারা শীতের কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে নরসিংদী ও মাধবদীর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘুরে ঘুরে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে দুস্থ্য ও অসহায় ছিন্নমুল মানুষদের মাঝে। এসব সংগঠনগুলোর এখনও কম্বল বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। অন্যদিকে শীত বাড়ায় নরসিংদীতে ঠান্ডাজনিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। নরসিংদী সদর হাসপাতালে বর্তমানে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বছরের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দুই- তিনগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকেই সদর হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভিড় করছেন। শীত বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়ে সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুল বাকি বলেন, ‘এ সময়ে যে কেউ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতা সম্ভব ঠা-া পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেইসঙ্গে ধুলোবালি থেকে যতা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে অভিভাবকদের।