১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। ঠিক এমন একটি সময়ে সাতক্ষীরা শহরে নিজের পত্রিকা অফিসে গুলি করে হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা স ম আলাউদ্দীনকে। সেই সময় হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে সাতক্ষীরায় ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে উঠে। অগাধ কালোটাকার মালিক হত্যা মামলার আসামীদের নানামুখি ষড়যন্ত্র স ম আলাউদ্দীন পরিবারকে কোণঠাসা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। একমাত্র শিশুপুত্রসহ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সাত সন্তাকে নিয়ে স ম আলাউদ্দীনের বিধবা স্ত্রী দিশেহারা প্রায়। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সেঝো সন্তান লায়লা পারভীন সেঁজুতি। কলেজ পড়ুয়া সেঁজুতি পিতার শিল্প কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু বন্ধ করে দিলেও বন্ধ হতে দেননি বাবার হাতে গড়া ‘বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি’। বর্তমানে তিনি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। ইতিমধ্যে ভাই-বোনরা লেখাপড়া শেষে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে অভিভাবকের দায়িত্বে ছিলেন লায়লা পারভীন সেঁজুতি। পারিবারিক নানা সংকটের মধ্যেও ছাত্র জীবনে বাবার দেখানো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন। ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিয়ে সক্রিয় হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দায়িত্ব পালন করছেন সাতক্ষীরা জেলা আওযামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। একই সাথে তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি দৈনিক পত্রদূত-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, জেলা স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সহ-সভাপতি, জেলা সম্প্রীতি বাংলাদেশের যুগ্ম-সম্পাদক, সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যসহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন লায়লা পারভীন সেঁজুতি। এর আগে দক্ষতার সাথে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তালার নগরঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লায়লা পারভীন সেঁজুতি রাজনীতি ও নানান সামাজিক কর্মকান্ড এবং নিজের পেশাগত জায়গায় যেমন দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় রেখে চলেছেন। একইভাবে ব্যক্তিগতজীবনে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী একজন মানুষ। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদকে। যিনি আশির দশক থেকে সাতক্ষীরার মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচার বিবোধী আন্দোলদের অন্যতম নেতা, সাতক্ষীরায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ইস্যুতে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী পরিচিতমূখ, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত সাবেক সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং একমাত্র পুত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সেঁজুতির পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম আলাউদ্দীন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যশোর-খুলনাঞ্চলের যুদ্ধরতদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহে বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেওসি মেজর জেনারেল আরুণ মুখার্জীর সাথে চুক্তি করেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। বিহারের চাকুলিয়ায় সপ্তাহের ট্রেনিং দিয়ে নির্বাচিত এমপি হয়েও কমিশন্ড অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের পর ক্যাপ্টেন সাইফুল্লাহ ছদ্মনামে ৮নং সেক্টরের অধীনে দেশে প্রবেশ করে পাকবাহিনী এবং বাজাকারদের বিরুদ্ধে ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অসংখ্যবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে জীবনে বেঁচে ফিরেছিলেন। এ সময় পকিস্তানি সামরিক আদালত স ম আলাউদ্দীনের অনুপস্থিতিতে বিচার করে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড, সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর তরুণ সেনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকান্ডের পর কয়েক দফা গ্রেপ্তার হন। তিনি ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন ও ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং জেলায় বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে স্বাধীনতায় পরাজিত শক্তির উত্থান রোধে ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, একই বছর জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ও তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। এ সময় মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জেলার ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠা, ভোমরা স্থল বন্দর প্রতিষ্ঠাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দলের অর্থের সংস্থানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন স ম আলাউদ্দীন। ওই কর্মকান্ডে দলের পাশাপাশি তিনি ব্যতিগতভাবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষর করা একটি চিঠি পেয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সবে দাঁড়ান এবং দলের প্রবীণ নেতা সৈয়দ কামাল বখত-এর পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পত্রিকা অফিসে ফ্যাক্সে আসা চিঠিতে দল ক্ষমতায় গেলে তাকে মূল্যায়ন করা হবে-উল্লেখ থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে, দ্রুত প্রচার হয় স ম আলাউদ্দীনকে টেকনোক্রাফট কোটায় মন্ত্রী হচ্ছেন। আর এটিই সম্ভবত তার জন্য কাল হযে দাঁড়ায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দোসরদের থেকে রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পূর্বেই ১৯ জুন রাতে সাতক্ষীরায় তারই প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রদূত অফিসে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম আলাউদ্দীনের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে চান তারই সেঝো সন্তান সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক লায়লা পারভীন সেঁজুতি। আর সেজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তিনি। তিনি বলেন, দল টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। ২০১৩ সালে এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীরা সন্ত্রাস নাশকতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ১৬জন নেতাকর্মীকে নৃশংস হত্যা করে। এরপর প্রশাসন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে দৃশ্যত তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তবে তারা ধর্মের নামে আওয়ামী লীগের সহজ সরল সাধারণ কর্মী সর্ম্পকদের ঘরে ঢুকে নারীদের মধ্যে ভোট ব্যাংক তৈরীর অপচেষ্টা চালাছে। নারী নেত্রী সেঁজুতি বলেন, আওয়ামী লীগের নারী কর্মীরাও বসে নেই। নানাভাবে কাজ করে চলেছি। তবে এইসব সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সমূলে বিনষ্ট করার জন্য নারীদের নেতৃত্ব পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থান খুব জরুরি। তবে যেখানে যেভাবেই থাকেন না কেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মসূচি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান।