বর্তমান বিশ্বে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে উদযাপন করা হয়। ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস; নামটা শুনতে ভালো লাগলেও এর মাঝে রয়েছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। বাংলাদেশে যেমন এর প্রচার প্রসার রয়েছে তেমনি সারা বিশ্বেই দিবসটিকে খুব আড়ম্বর, জাঁকজমকপূর্ণ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। এই জন্যই ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে পরিচিত।
এই দিনকে কেন্দ্র করে তরুণ-তরুণীরা সকালবেলা হলুদ শাড়ি পরে মাথায় একগুচ্ছ তাজা গোলাপ গুঁজে বেরিয়ে পড়ে নিজ প্রিয় মানুষ বা বন্ধুকে ভালোবাসার উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে। এমনকি এই দিনে এক শ্রেণীর বুড়া-বুড়িরাও পর্যন্ত নাচতে শুরু করে! ভ্যালেন্টাইন ডে-এর উৎপত্তি হয় ২৭০ সালের দিকে রোমের ভ্যালেন্টাইন নামক এক ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত কাহিনী দিয়ে। আর বাংলাদেশে এই ভ্যালেন্টাইন ডে-এর প্রচলন শুরু হয় নব্বই দশকে। এটা একটা পশ্চিমা অপসংস্কৃতি বললেই চলে। এটা নিশ্চয়ই মুসলমানদের পালনীয় কোনো দিবস বা আচার অনুষ্ঠান নয়। কিন্তু আমাদের এই ৯০% মুসলিমের দেশে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। যেটাকে ইসলামী শরিয়ত কোনোভাবেই সমর্থন করে না। শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালন করা হারাম। কেননা এই দিনে মানুষ মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমের অবমাননা করে আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধানের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে নিজেদের নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত করে। নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে জিনা, ব্যভিচার, মিথ্যাচার, ধর্ষণ, হারাম সম্পর্কসহ আরো বিভিন্ন গুনাহের কাজে। মুসলিম যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীদের অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা আর বেহায়াপনার চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। নিশ্চই এসব নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আল্লাহর কঠিন আজাব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত : ১৯) অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘স্বহস্তে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ো না। তোমরা সৎকর্ম করো, নিশ্চয় আল্লাহ্ মুহসিনদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
এই সম্পর্কে হাদিসে এসেছে আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান, পরে তারা তারই ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, যার অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দেবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনোই দেখা যায় নি।’ (ইবনে মাজাহ, কিতাবুল ফিতান, হাদিস নং ৪০০৯)
একইভাবে এই ভালোবাসা দিবস যেমন চরিত্র বিনষ্টকারী তেমনিভাবে সুন্দর শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ছাড়া আর কিছুই নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তারা তো পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়। আর আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না।’ ( সূরা আল মায়িদাহ, আয়াত : ৬৪)
মানুষ এটাকে ভালোবাসা দিবস বলে আখ্যা দিলেও ভালোবাসার সঠিক মর্ম সম্পর্কে তারা অবগত নয়। যদি মানুষ ভালোবাসার সঠিক অর্থ আর মহত্ব সম্পর্কে অবগত থাকত; তাহলে নিকৃষ্ট আর পাপাচারে ভরপুর এই দিনকে কখনোই ভালোবাসা দিবস নাম দিত না। ভালোবাসা হচ্ছে মহান আল্লাহ প্রদত্ত এক পবিত্র অনুভূতি বা সম্পর্ক। ভালোবাসা মানে হলো একে অন্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। আল্লাহ তায়ালা যেমন মানুষের মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি করেছেন তেমনি এই ভালোবাসার জন্য সীমাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সর্বোত্তম ভালোবাসা তো সেটাই যেটা মহান আল্লাহর জন্য মুমিনের অন্তরে উদিত হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অন্যের প্রতি সৃষ্টি হয়।
এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা এবং শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারো সাথে শত্রুতা রাখা।” (আহমদ, মুসনাদুল আনসার, হাদিস নং-২০৩৪১) অন্যত্র আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে প্রিয় হওয়া। ২. শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা। ৩. কুফুরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।’ (বুখারি, কিতাবুল ঈমান, হাদিস নং-১৫) এক মাত্র সেই পবিত্র ভালোবাসার অধিকারী যে নিজের ভালোবাসার দ্বারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আল্লাহ্ সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালোবাসার মতো তাদেরকে ভালোবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ্ প্রতি ভালোবাসায় তারা সুদৃঢ়।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৬৫)
প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। তাইতো মহান আল্লাহ তায়ালা বৈধভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছেন তবে সেটা নির্দিষ্ট দিনে নয়। বরং বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেলও একে অপরের প্রতি ভালোবাসা আর টান বহাল থাকে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ করো এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা আর রুম, আয়াত : ২১) আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে হেফাজত করুন, আমিন! লেখিকা : ইসলামবিষয়ক গবেষক