বরিশাল বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য পাতা রয়েছে নীরব ফাঁদ। অফিসের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাতে ফাইল ফেরত দিয়ে দালালদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য করেন তাদের। দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি পাসপোর্ট অফিসের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত পুলিশ, আনসার সদস্যদেরও প্রকাশ্যে টাকা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট অফিসের সামনে ও আশপাশের কম্পিউটারের দোকানগুলো তাদেরকে ‘পার্টি’ ধরিয়ে দেয়। সবাই মিলেই গড়ে তুলেছেন শক্ত সিন্ডিকেট। সহজে এবং ভোগান্তি ছাড়া কাজ করতে এই সিন্ডিকেটের দ্বারস্থ হতেই হয়। সব কার্যক্রম ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করলেও অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেন কোনো ব্যবস্থা নেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফাঁদের ধরন ॥
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কলেজছাত্র শহিদুল ইসলাম সব কাগজপত্র সঠিকভাবে নিয়ে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের আবেদন জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়ান। দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেনের হাতে জমা দেওয়ার পর তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিতে টিক দিয়ে জানান- আনতে হবে পরিচয়পত্রের ভেরিফিকেশন। এ সময় শহিদুল তার সঙ্গে থাকা পরিচয়পত্রের মূলকপি বের করেন। তবে কর্মকর্তা এতে সন্তুষ্ট নন। বাধ্য হয়ে শহিদুল সেখান থেকে বেরিয়ে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস থেকে ২১০ টাকায় সত্যায়িত জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নিয়ে ফেরেন। তবে ততক্ষণে দেড়টা বেজে যাওয়ায় পাসপোর্টের আবেদন নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। শহিদুল কর্মকর্তা মোশারেফের সঙ্গে দেখা করে ফাইলের বিষয়ে আলাপ করলে তিনি জানান, জেলা নির্বাচন অফিস থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভেরিফিকেশন করলে হবে না। উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে করে আনতে হবে এটি। জেলা আর উপজেলা নির্বাচন অফিসের মধ্যে পার্থক্য কী জানতে চাইলে ঐ কর্মকর্তা রুম থেকে বের করে দেন শহিদুলকে। তিনি বলেন, পাসপোর্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুইজন লোক আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। সম্ভবত তারা দালাল। একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন মেহেন্দীগঞ্জের বাসিন্দা আতিকুর রহমান। তিনি জানান, সবকিছু ঠিক করে ফাইল জমা দেওয়ার পর কাউন্টার থেকে ফাইল ফেরত দেওয়া হয়। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় কয়েকজন লোক তাকে জিজ্ঞাসা করেন- ভাই ফাইল ফেরত দিয়েছে? আপনি তো লাইনে বা সিস্টেমে নাই ভাই। এই লাইনে এলে সাধারণ লাইনেও দাঁড়াতে হবে না। ঐ দালালকে দেড় হাজার টাকা দিলে আধা ঘণ্টার মধ্যে আতিকুরের সব কাজ ক্লিয়ার হয়ে যায়। যেভাবে বাধ্য করা হয় লাইনে আসতে সরকারি ব্রমোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফজলুল হক নিজের পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং স্ত্রী-সন্তানের পাসপোর্ট করাতে যান রোববার সকাল সাড়ে ১০টায়। লাইনে দাঁড়িয়ে ফাইল জমা দেন। তবে তিন ঘণ্টা চলে গেলেও ডাকা হচ্ছিল না তার নাম। অবশেষে দুপুর ১টার দিকে তার নাম ডাকা হয়। তবে তার স্ত্রী এবং সন্তানের নাম ডাকায় কাউন্টারে গিয়ে হতাশ হয়ে ফেরেন। এ বিষয়ে ফজলুল হক বলেন, আমাকে পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা বলেছিলেন তিনটি পাসপোর্টে সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে প্রতিটিতে দুই হাজার টাকা করে অর্থাৎ তিনটিতে ছয় হাজার টাকা দিতে। এতে কোনো ভোগান্তি হবে না, বরং সব কাজ তারা করে দেবে বলেও জানানো হয়। তবে এতে রাজি হইনি আমি। পরে প্রস্তাব দেয় পাঁচ হাজার টাকা দিতে। তাতেও রাজি না হওয়ায় আমাকে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। তারা হয়তো বিভিন্ন ছুতোয় নিজেদের লাইনে নিতে চাইছে।
সহজ লাইনের সন্ধান ॥
ঢাকার বাসিন্দা জাহিদ হোসেনের মূল বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জে। তিনি বলেন, আমি তাড়াহুড়ো করে আসায় ইউনিয়ন সার্টিফিকেট আনতে পারিনি। পাসপোর্ট অফিসের এক স্যারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে একটি কম্পিউটারের দোকান দেখিয়ে দিলেন তিনি। এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সেখান থেকেই আমার ফাইল রেডি করে দেওয়া হয়। তারা আরেক ইউনিয়নের প্রত্যয়ন আমার ফাইলে দিয়ে দেন। তবে এতে কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু চার হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ পথে হাঁটলে কোনো সমস্যা কিংবা ভোগান্তি নেই। সব অফিসের একটা পালস আছে। আপনাকে সেটা বুঝতে হবে। লাইনে আসতেই হবে এই অফিসে।
ফাইলের ওপর চিহ্ন দেখে হয় কাজ ॥
বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সামনেই ফিশারি রোড। সেখানকার এক দোকানদার তিনি বলেন, চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র আর টাকা নিয়ে আসবেন। সব কাজ গুছিয়ে দেব আমি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের টাকা যদি পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তি দেন তাহলে সাড়ে সাত হাজার টাকা দিতে হবে। ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব আমার ওপর দিলে টাকা লাগবে নয় হাজার। পাসপোর্ট অফিসে আমার যাওয়াও লাগবে না। ফাইলের ওপর একটা চিহ্ন দিয়ে দেব। এতেই দেখবেন সবার আগে কাজ হয়ে গেছে আপনার। আর কাজ হবেই না কেন, ভাগ তো পায় সবাই। কয়েকজন দোকানি বলেন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা আছে। আমদের ধরা ফাইল থেকে তাদেরও ভাগ দিই। কোনো ফাইলে দুই হাজার টাকা আয় হলে তাদের ৫০০ দিতে হয়। এ ভাগ শুধু কর্মকর্তারা নয়, বড় চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিরাও পান। একই কথা জানান ঐ এলাকায় দোকান চালানো প্রায় পঞ্চাশজন। টাকা নিয়ে সমস্যার সমাধান দেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কর্মকর্তা কাউন্টার থেকে একের পর এক ফাইল ফেরত দেন। আর এসব কিছু ফাইলের সমস্যা সমাধানে দেন দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যরাও। প্রয়োজনে নিজে গিয়ে তারা ফাইল জমা দেন। এজন্য তাদের খুশি করতে হয়, এতে লাগে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশনে লাগে বকশিশ। পাসপোর্ট নিতে কয়েকজন জানান, তাদের কাছে যে পুলিশ সদস্য গিয়েছিলেন তিনি মোটরসাইকেলের তেল খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা চেয়েছিলেন। তারা এক হাজার করে টাকা দিয়েছেন। এছাড়া পাসপোর্ট করতে নির্ধারিত ফি থেকে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় বলেও অভিযোগ করেন সেবাপ্রত্যাশী। এছাড়া পাসপোর্ট অফিসে সাংবাদিক প্রবেশে দেওয়া হয় বাঁধা। এসব বিষয়ে মুঠোফোনে উপ-পরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেন বলেন, আপনি কেন পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন আমি তো বুঝি না। আর এসেছেন তা আমার সঙ্গে আগে কথা বলবেন না? এটি পাবলিক সেক্টর তো। বরিশালের এমন কোনো সরকারি অফিস নেই যেখানে ‘ই’ নেই। নোয়াখালীসহ অন্যান্য এলাকায় পাসপোর্ট যেভাবে করে, বরিশালে সেই সংখ্যক মানুষ পাসপোর্ট করে না। প্রসঙ্গত, গত ১৬ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন বরিশাল পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালায়। সে সময় আবু নোমান মো. জাকির হোসেন অনিয়ম রুখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আশ্বস্থ করেছিলেন। তবে অফিসটিতে পূর্বের অবস্থায় রয়ে গেছে সেখান থেকে একচুল পরিমান কোনো উন্নতি হয়নি।