আরবি গাফেল মানে উদাসীন। গাফলতি মানে উদাসীনতা। গাফলতি কাফের ও মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই গাফলতির কারণে তারা জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়াকে অবধারিত করে ফেলেছে। কোনো মুসলমান কখনো গাফেল বা উদাসীন হতে পারে না। যখন উদাসীনতা কোনো ব্যক্তিকে পেয়ে বসে তখন সে ইচ্ছাকৃত কল্যাণকর জ্ঞান ও কর্ম থেকে বিরত থাকে। শুধু নিজের ধারণা ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং শয়তান তার মনোবৃত্তিকে সুশোভিত করে দেয়। ফলে তার চিত্ত নানা কৃপ্রবৃত্তিকে ধারণ করতে থাকে।
একজন মুসলিমের উদাসীনতা হলো, সৎকর্ম থেকে উদাসীন হওয়া এবং গোনাহের শাস্তি সম্পর্কে উদাসীন হওয়া। ফলে সে-ও ধ্বংস ডেকে আনে এবং তার কল্যাণের পথগুলো রুদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের চোখের ওপর আবরণ পড়ে গেছে। তারা কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’ (সূরা বাকারা : ৭) অর্থাৎ বাস্তব সত্য তাদের সামনে উপস্থাপিত হওয়ার পরও তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করতে থাকে। যার ফলে কোনো সত্য তার বোধগম্য হয় না।
এদের সম্পর্কে কুরআন আরো বলছে যে, ‘আর এটি একটি অকাট্য সত্য যে, বহু জিন ও মানুষ এমন আছে যাদের আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা পশুর মতো বরং তাদের চেয়েও অধম। তারা চরম গাফলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯) এর অর্থ এটা নয় যে, আমি তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্যই সৃষ্টি করেছিলাম এবং তাদের সৃষ্টি করার সময় এ সংকল্প করেছিলাম যে, তাদের জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত করব। বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, আমি তো তাদের হৃদয়, মস্তিষ্ক, কান, চোখ সব কিছুসহ সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু এ বেকুফরা এগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেনি বরং তারা পশুদের চেয়েও নি¤œতর জীবনযাপন করে। পশুদের জ্ঞান-বুদ্ধি নেই কিন্তু তারা উদাসীন নয় বরং নিজস্ব পরিবেশে তারা সচেতন। কিন্তু মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন হওয়ার পরও যখন উদাসীন হয় তখন তাদের অবস্থান পশুদের থেকেও নি¤œতর পর্যায়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত তারা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হয়।
মনে রাখতে হবে, বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা যেহেতু দেয়া হয়েছে, তাই জ্ঞান ও বিজ্ঞতার অপরিহার্য দাবি হচ্ছে, তাকে তার কাজের জন্য দায়ীও করা হবে। যেই ক্ষমতা ও ইখতিয়ার তাকে দান করা হয়েছে, সেই ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সে কিভাবে ব্যবহার করেছে তার হিসাবও তার কাছ থেকে নিতে হবে। তাকে টাকা-পয়সা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দেয়া হয়েছে, সেই টাকা-পয়সা ও প্রভাব প্রতিপত্তি কিভাবে ব্যবহার করেছে, তার হিসাব দিতে হবে। যাকে নিজ দায়িত্বে সৎ ও অসৎ কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হবে তাকে তার সৎকাজের জন্য পুরস্কার ও অসৎকাজের জন্য শাস্তিও দিতে হবে।
যারা উদাসীন তারা নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। কুরআন ও হাদিসে খেয়াল-খুশির অনুসরণের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল কুরআনে রাসূল সা: সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তোমার বন্ধু পথভ্রষ্ট হয়নি বা বিপথগামীও হয়নি। সে নিজের খেয়াল-খুশিমতো কথা বলে না যা তার কাছে নাজিল হয় তা অহি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সূরা আন নজম : ২-৪) আয়াতে খেয়াল-খুশিমতো কথা বলাকে পক্ষান্তরে পথভ্রষ্টতা ও বিপথগামী বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা গাফেল বা উদাসীন তারাই পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী এবং তারাই কেবল নিজের খেয়াল-খুশিমতো চলে। এ ব্যাপারে আল-কুরআনে অনেক আয়াত বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারপর হে মুহম্মাদ! তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাজিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং আল কিতাবের মধ্য থেকে তার সামনে যা কিছু বর্তমানে আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী ও তার সংরক্ষক। কাজেই তুমি আল্লাহর নাজিল করা আইন অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করো এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরিয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি।’ (সূরা মায়েদা : ৪৮) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে গেলেও অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চেয়ে কল্যাণকামী। কাজেই ইনসাফ করতে গিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’ (সূরা নিসা : ১৩৫) আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলে দাও, হে আহলি কিতাব! নিজেদের দীনের ব্যাপারে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না, যারা তোমাদের পূর্বে নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং আরো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে আর সাওয়া-উস-সাবিলা থেকে বিচ্যুত হয়েছে।’ (সূরা মায়েদা : ৭৭)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এমন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা বাসনার (খেয়াল-খুশির) অনুসরণ করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন।’ (সূরা কাহাফ : ২৮) আল্লাহ আরো বলেন, ‘এমন কি কখনো হয়, যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হিদায়াতের ওপর আছে সে ওই নব লোকের মতো হবে যাদের মন্দ কাজকর্মকে সুদৃশ্য বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তারা নিজেদের প্রবৃত্তি (খেয়াল-খুশির) অনুসারী হয়ে গেছে?’ (সূরা মুহাম্মাদ : ১৪) আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেহেতু এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই হে মুহাম্মদ এখন তুমি সেই দীনের দিকেই আহ্বান জানাও এবং যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ। সেভাবে দৃঢ়তার সাথে তা আঁকড়ে ধরো এবং এসব লোকের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বা খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। এদের বলে দাও, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন আমি তার ওপর ঈমান এনেছি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করি। আল্লাহই আমাদেরও রব এবং তোমাদেরও রব তিনিই।’ (সূরা শুরা : ১৫)
আল্লাহ তায়ালা কেবল এতটুকু বলে ক্ষান্ত হননি যে, তোমরাই ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করো এবং ইনসাফের পথে চলো বরং বলেছেন, তোমরা ইনসাফের পতাকাবাহী হয়ে যাও। কেবল ইনসাফ করাই তোমাদের কাজ হবে না বরং ইনসাফের ঝা-া নিয়ে এগিয়ে চলাই হবে তোমাদের কাজ। জুলুম খতম করে তার জায়গায় আদল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে তোমাদের দৃঢ়সংকল্প হতে হবে। আদল ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সহায়ক শক্তির প্রয়োজন মু’মিন হিসেবে তোমাদের জোগান দিতে হবে। আদল ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি নিজেদের খেয়াল-খুশির বিরুদ্ধেও যেতে হয়, এমন কি নিজেদের বাপ-মা ও আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধেও যেতে হয়, তবু তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা উদাসীন হয় তারা আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। ফলে তাদের কল্যাণের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সে আর কল্যাণের পথ দেখতে পায় না। লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা