মাহে রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো মাহে রমজান। উম্মতে মুহাম্মদীর নৈতিক চরিত্র উন্নত করে সাহাবায়ে কিরামের মতো আদর্শ জীবন গঠন করার প্রশিক্ষণ এ মাসেই গ্রহণ করতে হয়। রোজা মানুষকে প্রকৃত ধার্মিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। রোজাদারদের ইবাদত-বন্দেগির ভেতর দিয়ে সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচার, অশোভন-অনাচার, দুরাচার-পাপাচার ও যাবতীয় অকল্যাণকর কাজকর্ম থেকে বিরত হয়ে সংযম সাধনার পথ ধরে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণের শিক্ষা দেয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে একত্রে ইফতার, দীর্ঘ তারাবি নামাজ, সেহির—এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজন রোজাদার ব্যক্তি মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। ঈদুল ফিতরের উৎসব উদ্যাপনের মাধ্যমে মাহে রমজানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
রমজান মাসের সম্পূর্ণ কার্যক্রমটি ইসলামি সংস্কৃতির মহান ঐতিহ্য বহন করে। রোজা মুসলমানদের আদর্শ চরিত্র গঠন, নিয়মানুবর্তিতা ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শিক্ষা দেয়। সত্যিকার মুমিন হিসেবে গড়ে ওঠার অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস এ রমজানুল মোবারক; এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব প্রকার নাফরমানি কাজ থেকে দূরে থাকার নামই ‘তাকওয়া’। রোজা বান্দার মনে আল্লাহর ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহর কাছে বান্দার মান-মর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় তাকওয়া। এটিই মানুষের মনে সৎ ও মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে। সুতরাং, যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে ভালো কাজ করতে পারলেই রোজা পালন সফল ও সার্থক হবে। এভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত প্রশিক্ষণ দ্বারা নিজেদের একজন সৎ ও খোদাভীরু নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। রোজার শিক্ষা নিয়ে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভ করতে পারে। মাহে রমজানের এ শিক্ষা যদি বাকি ১১ মাস কাজে লাগানো যায়, তাহলে পৃথিবীতে এত অশান্তি ও অনাচার থাকতে পারে না। যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে সংশোধিত হলো, সেই সফলকাম হলো।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত-১৪) মাহে রমজান মানুষকে ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত হওয়ার এবং কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজাদার একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি রিপু দমনপূর্বক রোজা পালন করেন। রোজার মাধ্যমে মানুষ পরমতসহিষ্ণুতা ও হতদরিদ্রের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার শিক্ষা লাভ করেন। রোজা মানুষের ভেতর ও বাহির—দুই দিকের সংশোধন করে। মানুষের বাতেন বা ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করা, অর্থাৎ আলোকিত করা এবং তাঁর স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধনপূর্বক প্রকাশ্যভাবে সুন্দর করে গড়ে তোলা রোজার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোজা মানুষকে পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। রোজা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মিতাচার, মিতব্যয়িতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। তাই মাহে রমজানে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবাইকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার দৃপ্ত শপথ নিতে হবে।
রোজা মানুষকে সংযমী মনোভাব গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেয়। রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা অন্তঃকরণকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। মাহে রমজানের এ শিক্ষাকে সবর বা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা বলা হয়। রোজাদার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধার্ত থাকেন এবং অনাহারী, অর্ধাহারীদের সঙ্গে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তাই মাহে রমজান মানুষকে দুঃখীজনের পাশে দাঁড়াতে শিক্ষা দেয়, সৃষ্টিজগতের প্রতি উদার, সহমর্মিতা ও দয়াশীল হতে শিক্ষা দেয়। মাহে রমজানের শুভদ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়; শুধু রমজান মাসে নয়, সমগ্র জীবনে যদি সবাই দুঃখীজনের পাশে থাকি, তবে মানবসমাজে আর কোনো রকম অসাম্য ও বর্ণবৈষম্য থাকতে পারে না। রোজা পালন করে মানুষ ইবাদত-বন্দেগির দ্বারা আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের শোকর আদায় করতে শেখে এবং শরিয়তের বিধিবিধানের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে। এভাবে যদি কেউ সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে ঐকান্তিকতার সঙ্গে রোজা রাখে এবং ধৈর্যের সঙ্গে যাবতীয় কষ্ট সহ্য করে, তাহলে সে অবশ্যই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে। তাই রোজাদারের জন্য আল্লাহ পাক নিজ হাতে সওয়াব প্রদানের সুসংবাদ দিয়েছেন। মাহে রমজানকে তাকওয়া অর্জন, নৈতিক চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সিয়াম সাধনার দ্বারা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা, ক্ষমা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি সদাচরণ জন্মায়। মাহে রমজানের যে মহান শিক্ষা, তা গ্রহণ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রোজা যে পরহেজগারি শিক্ষা দেয়, সে অনুযায়ী মানবজীবন পরিচালিত করা উচিত। মাহে রমজানে যে সংযম সাধনার শিক্ষা রয়েছে, আমাদের জাতীয় জীবনে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজান মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন থেকে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনসহ সর্বস্তরে অনুশীলনের দীক্ষা দিয়ে যায়। তাই আসুন, রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের প্রতি যতœবান হয়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করি, মানবিক গুণাবলিতে জীবনকে আলোকিত করি; তাহলে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা অর্থবহ হবে। তখন মানুষের মধ্যে গড়ে উঠবে সুমধুর সম্পর্ক, বিদায় নেবে অরাজকতা, অন্যায়-অনাচার এবং দুর্নীতি ও ভেজালমুক্ত হয়ে আদর্শ জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। রমজান মাসের সফল পরিসমাপ্তি সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন, আত্মসংযম, মানবপ্রেম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বয়ে আনুক।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্মবিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com