শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন

রমজান : অর্জন-বর্জনের মহাপ্রশিক্ষণ

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারি-১৯০১, কিতাবুস সাওম, বাবু মান সামা রামাদানা ঈমানান ও এহতেসাব…)
হাদিসে বিবৃত ঈমান ও এহতেসাব তাকওয়ার অপরিহার্য উপাদান। এ দু’টি ছাড়া তাকওয়ার কোনো অস্তিত্বই থাকে না। প্রথম উপাদানটি হলো- এমন এক বিশ্বাস, যে বিশ্বাস সর্বদা পরাক্রমশালী এক সত্তার ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। যে সত্তা নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা ও মহাপরিচালক, যিনি সর্বময় ক্ষমতা ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী, যিনি বিশ্বজাহান পরিচালনা করছেন এক মহাপরিকল্পনা মোতাবেক, যিনি গোটা দুনিয়ার প্রতিটি অণু-পরমাণুর পূর্ণ খোঁজখবর রাখেন, মানুষের দৈনন্দিন কল্যাণ-অকল্যাণ, ভালো-মন্দ যার নিয়ন্ত্রণাধীন, প্রকৃতি রাজ্যের যিনি মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারী। দ্বিতীয় উপাদানটি হলো- সর্বদা নিজের চিন্তা-কল্পনা ও কাজ-কর্মের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
ঈমানের সাথে রোজা রাখা : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি একজন মুমিন যেই ঈমান বা বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন, সেই ঈমানকে সামনে রেখে রোজা পালন করা হলে অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। একজন মুমিন আল্লাহ সম্পর্কে যে আকিদা পোষণ করেন তা হলো-‘আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর প্রতি, যেমন তিনি আছেন তাঁর যাবতীয় নাম ও গুণাবলিসহ এবং কবুল করে নিলাম তাঁর যাবতীয় হুকুম-আহকাম ও সব নিয়মকানুন। আল্লাহর প্রতি ঈমানের মূল কথা হলো- ‘তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসূল।’ এখানেই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মূল স্বীকৃতি দেয়া হয়। তথাপি উল্লিখিত প্রথম কালিমায় মুমিন আল্লাহর সিফাতি নামগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর যাবতীয় হুকুম-আহকাম ও নিয়ম-কানুন মেনে চলার অঙ্গীকার করে। যে ঈমানের কথা আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে- ‘তার রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে রাসূল তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে এবং অনুরূপভাবে মুমিনগণও। তাঁরা সবাই আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতা, কিতাবসমূহ ও রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখে। (তারা বলে) আমরা রাসূলদের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করি না। আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। (অতএব) হে আমাদের রব! তোমার মার্জনা কামনা করি (কারণ) তোমার কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ (সূরা বাকারা-২৮৫)
মুমিন রোজাদার আল্লাহর সিফাতি নামগুলোর মতো ‘ওয়াল্লাহু বাছিরুম বিল ইবাদ’ ও ‘সামিউম বাছির’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ শুনেন দেখেন’ এর প্রতি বিশ্বাসের ফলে সারা দিনের ক্ষুধা-পিপাসার দুঃসহ জ্বালা নিবারণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ ‘দেখেন’ এ নামের ভয়ে সে সুযোগ গ্রহণ করেন না। অবিরত ও ক্রমাগত একটি মাসে ট্রেনিংয়ের ফলে আল্লাহর সিফাতি নামগুলোর কার্যকারিতা এমনভাবে হৃদয়ের গভীরে অঙ্কিত হয় যে, বাকি ১১টি মাস সব প্রকার গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারে। এমনিভাবে একজন মুমিন আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করে যে তিনি ‘মালিক’, তিনি ‘রব’, তিনি ইলাহ, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব কিছুরই একচ্ছত্র মালিকানা তাঁর। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আসমান ও জমিনে তাঁরই রাজত্ব বিস্তৃৃত। আমাদের মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা যদি এ ধরনের ঈমান পোষণ করে থাকেন, তবে আমার প্রশ্ন পৃথিবীর অধিকাংশ অমূল্য সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেন পশ্চিমা মোড়লদের চক্ষু রাঙানোকে ভয় করেন? কেন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকেন? অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘(হে রাসূল) বলো : হে আল্লাহ! বিশ্ব-জাহানের মালিক! তুমি যাকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা দান করো এবং যার থেকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নাও। যাকে চাও মর্যাদা দান করো, যাকে চাও লাঞ্ছিত করো। কল্যাণ তোমার হাতেই নিহিত। নিঃসন্দেহে তুমি সব কিছুর উপর শক্তিশালী।’ (সূরা আলে ইমরান-২৬) আর আমরা যারা সাধারণের কাতারে আছি তাদের অবস্থা তো আরো নাজুক। জীবনে কতবারই না রমজানের সাক্ষাৎ মিলেছে কিন্তু আগে যেখানে ছিলাম সেখানেই তো রয়ে গেলাম। জীবনের কিঞ্চিত পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করি না। একজন রোজাদার কিয়ামুল লাইল তথা তারাবির নামাজের মাধ্যমে এমন কতগুলো বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন, কিন্তু ঘোষণাগুলো আমাদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয় না। বাস্তবতা এ দোয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রতি নামাজেই অসংখ্যবার বলা হচ্ছে- ‘আমরা তোমারই গোলামি করি আর তোমারই সাহায্য চাই।’ অথচ নামাজের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। রোজা অবস্থায় খাদ্য গ্রহণ করলে আল্লাহ দেখবেন এ ঈমান থাকার দরুন রোজা ভঙ্গ করেন না, কিন্তু খাদ্যে যখন ভেজাল মেশানো হয় তখন কি আল্লাহ দেখেন না? এমনিভাবে নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশন করা বিক্রিতব্য মালের দোষ-ত্রুটি গোপন করা, মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ফায়দা লোটা, মাপে বা ওজনে কমবেশি করাও হারাম বা অবৈধ দ্রব্যাদির ব্যবসায় করার সময় কি আল্লাহ দেখেন না? সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়ে আল্লাহ কি বেখবর? আর একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো- রমজানের আগমনবার্তা পেলেই আল্লাহর রাসূল সা:-এর রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের পূর্ণ ফায়দা গ্রহণের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। অথচ আমাদের দেশে মুসলমান নামধারী কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী রমজানে অধিক মুনাফা লাভের জন্য মজুদদারির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়।
এহতেসাবের সাথে রোজা রাখা : হিসাব করে করে রোজা পালন করার অর্থ এই নয় যে, কয়টি রোজা এলো এবং কয়টি গেল; বরং এর অর্থ হলো- রমজানের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রতিটি কথা ও কাজের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা। দিন শেষে নিজের ভালো কাজ এবং খারাপ কাজগুলোর হিসাব করা। ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় এবং ভবিষ্যতে যেন আরো ভালো কাজ করতে পারা যায় এ জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। আর মন্দ কাজগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া এবং ভবিষ্যতে না করার অঙ্গীকার বা তওবা করা। আর একটু সংক্ষেপে বলা যায়- রোজাদার প্রতিদিনকার প্রতিটি কথা ও কাজের প্রতি এমন ধরনের তীক্ষè ও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন যে, কাজগুলো আল্লাহর মর্জি মোতাবেক হচ্ছে, নাকি শয়তানের মর্জি মোতাবেক। আরো সংক্ষেপে বলা যায় এভাবে যে, রোজাদার রমজানের রোজাগুলো আত্মসমালোচনা, আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে অতিবাহিত করবে।
আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে, সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কুপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করে, সেই অক্ষম।’ (তিরমিজি)
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ব-জাহান ও আখিরাতের সব কর্ম সম্পাদনে আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি ও কর্মীবাহিনী রয়েছেন। এরা হলো- আল্লাহর ফিরিশতা। এদের প্রতি ঈমানের একটি তাৎপর্য হলো এই যে, তারা আল্লাহর নির্দেশে মানুষের দৈনন্দিন কাজের রেকর্ড সংরক্ষণ করেন, যা হাশর বা বিচারের দিনে মহান আল্লাহর এজলাসে চার্জশিট আকারে দাখিল করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের উপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে, এমন সম্মানিত লেখকরা, যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।’ (সূরা ইনফিতার : ১০-১২) প্রকাশ্যে ও গোপনে, অন্ধকারে, একান্ত নির্জনে, জনমানবহীন গভীর অরণ্যে আমরা কী করছি আল্লাহর বিশেষ ক্ষমতা বলে এসব তত্ত্বাবধায়ক নিরপেক্ষভাবে রেকর্ড করে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আপন কর্মের রেকর্ড পড়ো। আজ তোমার নিজের হিসাব করার জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৪) তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভালো-মন্দের পার্থক্য করে চলার এক বিশেষ ট্রেনিং হলো রমজান।
রমজানে দিনের বেলায় এমন দু’টি বৈধ জিনিসকে আমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে যা মূলত হালাল এবং দু’টি জিনিস আল্লাহ আল-কুরআনের মাধ্যমে আমাদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর এ দু’টি জিনিসই ভোগ করে মানুষ এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, এ ছাড়া মানুষ থাকতে পারে না। রমজানে ক্রমাগত ৩০টি দিন হালাল দু’টি জিনিসকে বর্জন করতে করতে এমন শক্তি অর্জিত হয়, যার মাধ্যমে জীবন চলার বাঁকে শয়তান কর্তৃক পেতে রাখা অতি লোভনীয় বস্তুকেও বর্জন করে মুমিন ভালো কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারে। এটিই তাকওয়া বা তাকওয়ার শক্তি। যে তাকওয়া ঈমান ও এহতেসাব দ্বারা সমৃদ্ধ। রমজানের মাধ্যমে এ অমূল্য সম্পদ অর্জন করা হয়। এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজা একটি ঢালের ন্যায়’। (বুখারি-১৯০৪, কিতাবুস সাওম, বাবু হাল ইউকুলু ইন্নি…) রমজানে যদি আমরা এ শক্তি অর্জন না করতে পারি, তবে আমাদের সিয়াম শুধু ক্ষুধা এবং কিয়ামুল লাইল শুধু রাত জাগা ছাড়া আর কিছুই হবে না। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘কতক রোজাদার এমন রয়েছেন যাদের রোজা শুধু ক্ষুধা ছাড়া কিছুই দেয় না, কতক রাত জাগরণকারী এমন রয়েছেন যাদের রাত জাগরণ শুধু জাগরণ ছাড়া আর কিছুই পায় না।’ লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com