শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩:১০ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশে চিনির দাম ভারতের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৪

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চিনির দামের পার্থক্য দীর্ঘদিনের। ভারতের বাজারে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৩ রুপিতে। বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৫৭ টাকা। সেখানে বাংলাদেশের বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। ভারতের প্রায় আড়াই গুণ দামে চিনি কিনে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা। বাড়তি দামের জন্য সরকারের অতিরিক্ত করকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। পার্শ্ববর্তী দুই দেশের চিনির দামে এত বড় ফারাক নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। তবে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বড় পার্থক্য বাংলাদেশ আমদানিকারক আর ভারত চিনির রপ্তানিকারক দেশ। তবে মাঝে মধ্যে নিজেদের উৎপাদন কম হলে ভারতও চিনি আমদানি করে। ভারত থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেও পরিশোধন করছে বাংলাদেশের মিলগুলো। আবার বাংলাদেশের মতো ভারতের ব্যবসায়ীরা শুল্ক-কর পরিশোধ করে বাজারে সেই চিনি তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করছেন ভারতের বাজারে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মধ্যে এ দামের বড় ফারাক আসলে কতটুকু প্রাসঙ্গিক।
দামের এ ফারাকের কারণে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। রামপুরা বাজারে চিনি কিনতে এসে ইয়াসির হোসেন বলেন, ‘সব সময় দেখবেন চিনি নিয়ে খামখেয়ালি হয়। সরকার একদম নির্ধারণ করে দেয় কিন্তু বাজারে গেলে সে দামে চিনি পাওয়া যায় না। তারা (কোম্পানিগুলো) কিছু মানতে চায় না ‘
তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুল আমাদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে। সরকারও তাদের কিছুই বলে না। প্রায় ছয় মাস ধরে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় চিনি কিনছি।’ মৌলভীবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী আবু হোসেন বলেন, ‘চিনি কোম্পানিগুলো সব সময় তাদের মনমতো চিনির দাম নির্ধারণ করে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও তারা কমাতে চায় না, কিন্তু বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তারা দাম বাড়িয়ে দেয়।’
সব মিলিয়ে প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর আরোপিত হয় ৬০ শতাংশের ওপর, টাকার অঙ্কে যা ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি চিনিতে সরকারকে দিতে হচ্ছে এত টাকা। এটা ভারতে নেই। চিনি ভারতের নিজস্ব পণ্য। তারা বিশ্ববাজারে চিনি রপ্তানি করে। উল্টো ভারত সরকার চিনিতে প্রণোদনা দিতে পারে।- সিটি গ্রুপের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা
তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর আরেক অস্ত্র ‘কৃত্রিম চিনির সংকট’ তৈরি করা। যখন খুশি মিল থেকে সরবরাহ বন্ধ করে ব্যবসায়ীদের থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে। দাম বাড়লে কম দামে বিক্রি করা ডিও’র চিনি দিতে চায় না। তখন বাজারে এমনিতেই সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হয়ে চিনির দাম বেড়ে যায়।’
দেশের চিনিকলের মালিকরা বলছেন, অবৈধভাবে চিনি আসার কারণে বৈধপথে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। পাশাপাশি অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে দেশের চিনিকলগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে বৈধপথে চিনি আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন অনেক আমদানিকারক। চোরাচালান বন্ধে সরকারের কাছে সহযোগিতা চান তারা। দেশে দেশবন্ধু, আবদুল মোনেম, এস আলম, মেঘনা, সিটি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। বাংলাদেশের চিনির বাজার এখন মূলত এই পাঁচটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। কারখানাগুলো হলো- মেঘনা সুগার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রি, এস আলম রিফাইন্ড সুগার রিফাইনারি, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি ও দেশবন্ধু সুগার রিফাইনারি। এসব কারখানা অপরিশোধিত চিনি এনে পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে। বেসরকারি এ পাঁচটি চিনিকলের দৈনিক পরিশোধনের সক্ষমতা ১৫ হাজার টনের বেশি। সারাদেশে চিনির দৈনিক চাহিদা সাড়ে ছয় হাজার টন। অর্থাৎ, চাহিদার তুলনায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে বছরে ৩০ হাজার টনের মতো চিনি উৎপাদন হচ্ছে। সব মিলে দেশে চিনির জোগানের কোনো ঘাটতি নেই।
পাশের দেশ ভারতের তুলনায় চিনির দামে কেন এত ফারাক- এ প্রশ্নে দেশের অন্যতম চিনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘সব মিলিয়ে প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর আরোপিত হয় ৬০ শতাংশের ওপর, টাকার অঙ্কে যা ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি চিনিতে সরকারকে দিতে হচ্ছে এত টাকা। এটা ভারতে নেই। চিনি ভারতের নিজস্ব পণ্য। তারা বিশ্ববাজারে চিনি রপ্তানি করে। উল্টো ভারত সরকার চিনিতে প্রণোদনা দিতে পারে।’
ভারত নিজেরা উৎপাদন করে, এটা তাদের দেশে চিনির দাম কম থাকার কারণ হতে পারে। তবে দামের পার্থক্য এত হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা মুনাফা বেশি করেন, সেই অভিযোগও আছে।- বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বিশ্বজিৎ সাহা হিসাব দিয়ে বলেন, ‘এখন ভারতে খুচরামূল্য ৬০ রুপি। সেটা আমাদের দেশের ৮০ টাকা। এর সঙ্গে ৪২ টাকা যোগ হয়ে হয় ১২২ টাকা। এছাড়া আমাদের প্রতি কেজি চিনিতে পরিবহনসহ অন্য ব্যয় ১৬ টাকা। অর্থাৎ, মোট ১৩৮ টাকা। সেখানে আমরা এখন মিলগেটে চিনি বিক্রি করছি ১৩২ টাকা। আমাদের প্রতি কেজিতে ৬ টাকা লোকসান হচ্ছে ‘
ভারতের চিনিমন্ডি ডটকমে চিনির সর্বোচ্চ দাম ৪৩ রুপি উল্লেখ রয়েছে যেখানে বিশ্বজিৎ সাহা চিনির দাম ৬০ রুপি ধরে ওই হিসাব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বললে তিনি বলেন, ওটা এক্সপোর্ট প্রাইস। দামে কিছুটা হেরফের দেখা গেলেও প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর ৪২ টাকা দিতে হয় এটা সত্য। এ শুল্ক কমাতে বহুবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির শুল্ক তুলে নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠিও দিয়েছে। তবে সেটা কার্যকর হয়নি কখনো। যদিও এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর কোনো বক্তব্য দেয়নি।
বাংলাদেশে চিনির দাম ভারতের আড়াই গুণ: এদিকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এ চিনির প্রায় পুরোটা বিদেশ থেকে আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। এসব বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘ভারত নিজেরা উৎপাদন করে, এটা তাদের দেশে চিনির দাম কম থাকার কারণ হতে পারে। তবে দামের পার্থক্য এত হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা মুনাফা বেশি করেন, সেই অভিযোগও আছে।’
দেশের বাজারে অবৈধ ভারতীয় চিনি: দামের এমন অসামাঞ্জস্যের কারণে দেশে এখন চিনি চোরাচালান বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, প্রতিদিনই অবৈধভাবে চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ চিনি ভারতের সীমান্ত দিয়ে আসছে। যে কারণে সরকার তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। নি¤œমানের চিনি কিনে প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তা। এছাড়া বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে দেশি চিনিকলগুলো বন্ধ হওয়ার সম্মুখীন।
মিল মালিকরা জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশি ব্র্যান্ড ফ্রেশ, দেশবন্ধু, তীর, এস আলমসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে মোড়ক ও তাদের বস্তা ব্যবহার করছে। এতে ওইসব ব্র্যান্ড আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে তাদের ব্র্যান্ড ইমেজ। জনসাধারণের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠা এসব চোরাই চিনি শিগগির অপসারণ এবং সরকারের কাছে এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে মোট চিনি আমদানি হয়েছিল তিন লাখ ৮৮ হাজার টন। সেখানে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৩৬ হাজার টন। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে দেড় লাখ টনের বেশি চিনি কম আমদানি হয়েছে। চিনি চোরাচালান হতে পারে এর কারণ।-জাগোনিউজ২৪.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com