গুনাহ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, মহাপরাক্রমশালী শান্তি ও শাস্তিদাতা, সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর এমন মানুষের তওবা কবুল করা হয় না, যারা পাপ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মরণ আসে, তখন বলতে থাকে, আমি এখন তওবা করছি। আর যারা কুফরি অবস্থায় মারা যায় তাদের তওবা কবুল করা হয় না। তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা নিসা-১৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তওবা করো। আশা করা যায় তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কাজসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের দাখিল করাবেন জান্নাতে’ (সূরা তাহরিম-৮)। ওই আয়াতে (তওবাতান নাসুহা) তথা তওবায়ে নাসুহা বা খালেছ তওবার কথা বলা হয়েছে। তওবায়ে নাসুহা বলা হয় অতীত কৃতকর্মের ওপর অনুশোচনা এবং ভবিষ্যতে গুনাহের কাজে পুনরায় লিপ্ত না হওয়ার অঙ্গীকার করা। আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ: তওবায়ে নাসুহার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তওবা হচ্ছে আল্লাহপ্রেমিক ব্যক্তিদের উত্তম স্থান এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত লোকদের প্রথম এবং শেষ সোপান।’ মোমেন লোকেরা কখনো তওবা থেকে দূরে থাকতে পারে না। আমৃত্যু তওবা করতে থাকে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা:কে তওবায়ে নাসুহা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বললেন, তওবায়ে নাসুহা হলো- ‘মানুষ স্বীয় অন্যায় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে এমনভাবে তওবা করে যে ভবিষ্যতে তার দ্বারা এ ধরনের অন্যায় কাজ আর সংঘটিত হয় না।’ আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক এমন আছে তারা তওবা করতে বিলম্ব করে এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখন তো বয়স কম যেমন ইচ্ছা তেমন চলার বয়স, এখনই যদি তওবা করে ভালো হয়ে যাই তাহলে দুনিয়ার মজাতো আর বোঝা হলো না। খাও দাও ফুর্তি করো এর ওপর জীবন চালানো হলো না। তাই বয়স হলে সুযোগ-সুবিধা মতো তওবা করে নেবো। বস্তুত তারা এক মহাভ্রান্তির জালে ফেঁসে আছে। দীর্ঘ জীবনযাপনের কামনা বাসনা করছে। তারা একটুও চিন্তা করছে না এ দুনিয়াতে আসার সিরিয়াল আছে যাওয়ার কিন্তু কোনো সিরিয়াল নেই। মৃত্যু কাউকে সংবাদ দিয়ে আসে না। যখন মৃত্যু চলে আসবে তখন কাউকে মৃত্যু ছাড়বে না। পরকালে হাজারও আক্ষেপ করলেও কোনো কাজে আসবে না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘যাতে কেউ আল্লাহর দরবারে এ কথা বলতে না পারে, হায়! হায়! আমি আমার কর্তব্যে অবহেলা করেছি। আমি তো ঠাট্টা-বিদ্রƒপকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। অথবা না বলে, আল্লাহ যদি আমাকে পথপ্রদর্শন করতেন, তবে আমি পরহেজগারদের একজন হতাম। অথবা আজাব প্রত্যক্ষ করার সময় না বলে, যদি কোনোরূপে একবার (দুনিয়াতে) ফিরে যেতে পারি, তবে আমি সৎ কর্মপরায়ণ হয়ে যাব’ (সূরা জুমার : ৫৬, ৫৭, ৫৮)। আলোচ্য আয়াতসমূহ দ্বারা বোঝা গেল তওবা ও সব নেক আমল করার স্থান দুনিয়াতে, পরকালে নয়। পরকালে হাজারো আহাজারি করা যাবে কিন্তু কোনোই কাজে আসবে না। সুতরাং হায়াত থাকতে হায়াতকে মহামূল্যবান মনে করা উচিত। একজন বান্দার জন্য সার্বক্ষণিক মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য পাওয়ার ধ্যান করা উচিত। আল্লামা ইয়াহইয়াহ ইবনে মাআয রহ: বলেন, অধিক উচ্চাভিলাষ মানুষকে তওবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর পরকালমুখী বান্দারা আল্লাহর কাছে বেশি তওবা করে। সূরা আল ইমরানের ১৩৫-৩৬ নং আয়াতে প্রকৃত তওবাকারীদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে- ‘তারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা করে না এবং জেনে-শুনে তাই করতে থাকে না। তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত। যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ, যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা কাজ করে তাদের জন্য কতই না চমৎকার প্রতিদান।’ আল্লামা হাফেজ ইবনে কাসির রহ: এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আনাস রা:-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন, এই আয়াতদ্বয় নাজিল হওয়ার সময় ইবলিস শয়তান অনেক কেঁদেছিল। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘ইবলিস বলল : হে প্রতিপালক আপনার মহিমার শপথ যতক্ষণ আপনার বান্দার প্রাণ তার শরীরে সংযুক্ত থাকবে ততক্ষণ আমি তাকে বিপথগামী করা থেকে বিরত থাকব না। আমি তাদের পথভ্রষ্ট করতে থাকব। তার উত্তরে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ‘আমার মাহাত্ম্য ও মহিমার কসম করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বান্দা আমার কাছে গুনাহের জন্য তওবা করতে থাকবে আমি তাদের গুনাহ ক্ষমা করতে থাকব (মুসনাদে আহমদ)। ইবলিস শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য যতই পাঁয়তারা করুক না কেন, বান্দা যদি এক আল্লাহর ওপর ভরসা করে পথ এগোতে থাকে, তাহলে স্বীয় কর্মের জন্য লজ্জিত ও অপমানিত মনে করে এবং বিনয়ের সাথে কায়মনোবাক্যে তওবা করে, অতঃপর নিজের বদ-আমল সংশোধন করে গুনাহের কাজ পরিহার করে চলে তাহলে আল্লাহ পাক এমন বান্দার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং (হুককুল ইবাদ) বান্দার হক ব্যতীত তার সব ছোট-বড় গুনাহ মাফ করে দেন।
রাসূল সা: প্রতিদিন শতবার তওবা করতেন। এখানে বোঝার বিষয় হলো নবীরা মাসুম তথা নিষ্পাপ। এখন প্রশ্ন হলো রাসূল সা: কেন প্রতিদিন শতবার তওবা করতেন? উত্তরে এ কথাই বলতে হবে রাসূল সা: ছিলেন উম্মতের ইমাম ও রাহবারে কামেল। তিনি মূলত উম্মতকে শিক্ষা দেয়ার জন্যই প্রতিদিন শতবার তওবা করতেন। নবীজি তো তওবা করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব নবীজির শিক্ষার ওপর জীবন গড়া।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট