সংসদে উপস্থাপিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট ঋণনির্ভর, লুটেরাবান্ধব মন্তব্য করে করে এই প্রত্যাখান করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই বাজেট কর নির্ভর, ঋণ নির্ভর, লুটেরা বান্ধব। অসহনীয় মুদ্রাস্ফীতির চাপে সাধারণ জনগণের ত্রাহি অবস্থা, এর উপরে বাজেটে করের বোঝা। এ বাজেট কল্পনার এক ফানুস, ফোকলা অর্থনীতির উপরে দাঁড়িয়ে আছে।
লুটেরা সরকারের এই বাজেট কেবলমাত্র দেশের গুটিকয়েক অলিগার্কেদের জন্য, যারা শুধু চুরিই করছে না, তারা ব্যবসা করছে, তারাই পলিসি প্রণয়ন করছে, আবার তারাই পুরো দেশ চালাচ্ছে। জবাবদিহিতাহীন এই সরকারের কাছ থেকে জনকল্যাণমূলক বাজেট আশা করাটাই বোকামি। আমরা এই বাজেট প্রত্যাখান করছি। গতকাল রোববার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপরে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই বাজেট পুরোপুরি ঋণ নির্ভর। তারওপর ঘাটতি বাজেট। সেই ঘাটতি মেটানো হচ্ছে ঋণ দিয়ে। একদিকে বৈদেশিক ঋণ, অনদিকে ডোমেস্টিক লোন। যে মানুষগুলো অলিরেডি খাদের (গর্ত) মধ্যে পড়ে গেছে, তাদের ওপরে কথাকথিত হাতি চেপে বসেছে, তাদের কাছ থেকেও ঋণ নেয়া হয়। পুরো বাজেটটাই করা হয়েছে মেগা প্রকল্প, মেগা চুরির জন্য, দুর্নীতি করার জন্য।
তিনি বলেন, অর্থনীতির এই ত্রিশঙ্কুল অবস্থায় উচিত ছিলো অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পসমূহ বা অর্থহীন, অনুৎপাদক দৃশ্যমান অবকাঠামোগুলো বন্ধ রাখা। সেই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূখী খাতে ব্যবহার করা যেতো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও সম্প্রসারিত করার যেতো। কিন্তু সেগুলা বন্ধ করলে তো দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই বোধগম্য কারণেই সেটা করা হয়নি। শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্ধ কমিয়ে দেয়ার সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে অত্যন্ত।কৃষির বরাদ্ধও তারা কমিয়ে দিয়েছে। অথচ করোনাকালে পুনরায় প্রমাণিত হয়েছে আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। সরকার কৃষিকে সহায়তা না করে ক্যাপাসিটি চার্চের নামে লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকির অর্থ তুলে দিয়েছে বিদ্যুৎ সেক্টারের অলিগার্কদের হাতে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যু না কিনেই।
বাজেট দিক-নির্দেশনাহীন উল্লেখ করে অর্থনীতির সাবেক এই শিক্ষক বলেন, এই বাজেটে কর্মসংস্থানের তৈরির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ডলার সংকটের কথা বলে আমদানি সংকুচিত করায় ক্যাপিটাল মেসিনারিস এবং কাঁচা মাল আমদানি প্রায় অবরুদ্ধ। যার ফলে শিল্প কারখানা বন্ধের পথে। ব্যাংকগুলো শূণ্য। সুদের হার অনেক বেশি। সরকার নিজেই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমান অর্থ ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি সেক্টারে ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ কমে গেছে। ডিএফআই (ডাইরেক্ট ফরেন ইনভেষ্টমেন্ট) ও শূণ্যের কোঠায়। নতুন কর্মসংস্থান না থাকায় শ্রমিকরা গ্রামে চলে যাচ্ছে, সেখানেও কর্মের সংস্থান নেই। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো আশা বাজেটে নেই। নেই চাকরি হারা এবং দুর্দশাগ্রস্থ শ্রমিকদের পুনর্বাসন রোড ম্যাপ নেই।
তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলা হলেও তার বাস্তবিক কোনো পথনির্দেশনা নেই এই বাজেটে। এই বাজেট শুধু গণবিরোধী নয়, এই বাজেট বাংলাদেশ বিরোধী। যে গণমানুষ নিয়ে বাংলাদেশ, সেই গণমানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পুরো বাজেটটা করা হয়েছে লুটেরাদের জন্য।
মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা কমানো বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো পথ নির্দেশনা নেই উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, মূল্যস্ফীতির চরম চাপে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। কিভাবে এই মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে তার কোনো কথা নেই বাজেটে। কে না জানে, সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাদের আশীর্বাদপুষ্ঠ কিছু সিন্ডিকেটের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কয়েকগুন বেড়েছে। এই সকল সিন্ডিকেট কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাজেটে সেই বিষয়ে কোনো আলোচনাই স্থান পায়নি।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে বেশি। পুরো বোঝাটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে। ঋণ ও ঘাটতি ভিত্তিক বাজেটপ অতীতেও বাস্তবায়ন হয়নি, আগামীতেও হবে না। বাজেটের এক তৃতীয়াংশ ঘাটতি যা মেটানোর প্রস্তাব করা হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে। ঋণ দিয়ে ঋণ পরিশোধের ফন্দি। অর্থাৎ কৈ এর তেলে কৈ ভাজা আর কি। এই ঋণ নেয়া হবে সোভারেন গ্যারেন্টির কভারে। কারণ কো-লেটারেল দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থা ফ্রিটচ রেটিংস অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদি ঋণমান আবারও অবনমন করেছে। এর আগে মুডিস ও এস এন্ড পিও বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো দেউলিয়া সরকারের ওপর কার আস্থা হবে ঋণ দিতে? খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি এবং আদায় না হওয়া, অর্থ পাচার, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য রোধে সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনাও করেন বিএনপি মহাসচিব।
বাজেট প্রস্তাবে মুঠো ফোনে কথা বলার বিল ও ইন্টারনেট পরিষেবার বিল এবং ল্যাপটপের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাবের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মুখে ‘ডিজিটাল’ কথা বললেও তথ্য প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করার সরকারি ঘোষণাকে মিথ্যা আশ্বাস ও ফাঁপা বুলিই প্রতিয়মান হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, যে সরকার নিজেরাই আইনকানুন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে তারা কিভাবে আর্থিক ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কতিপয় অর্থ-পিপাসু অলিগার্ক ও দুষ্ট রাজনীতিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সরকারি কাজে ব্যয় সংকোচন, ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা স্থাপন কিংবা আর্থিকখাতে মৌলিক সংস্কার নিয়ে এই বাজেটে কোনো উদ্যোগ নেই।
কালো টাকা সাদা করতে বাজেট প্রস্তাবের সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশ এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের নিপতিত। এর মূল কারণ সুশাসনের অভাব ও জবাবদিহিহীন এই মাফিয়া সরকার। এই মহাসংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় এই মাফিয়া চক্রে ও চেপে সবা মাফিয়া স্বৈরশাসকের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। অবিলম্বে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেটা একমাত্র সম্ভব একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র এই ধাপ্পাবাজির অবসান ঘটিয়ে জনগনের ভোটাধিকার প্রয়োগের অবাধ ও নিরপেক্ষ সুযোগ সৃষ্টি করতেই হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।