ঢাকার দিল্লি পাবলিক স্কুলের ও লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীর পরীক্ষার বাকি ছিল কয়েক মাস। পড়া মনে থাকছে না বলে কান্নাকাটি করছিল সে। পরে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। চিকিৎসার একপর্যায়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করলে বাবা-মা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করেন। অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বিএমডিসি। মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আহমেদ রশীদ ও মা শর্মিষ্ঠা আহমেদ বলে আসছিলেন, তাঁদের মেয়ে ঐশী আত্মহত্যা করেনি; ভুল চিকিৎসায় মেরে ফেলা হয়েছে। ঘটনার বিচারে ২০২১ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা। যদিও এর দুই বছর আগে থেকে তাঁরা অনানুষ্ঠানিকভাবে একই অভিযোগ করছিলেন।
অভিযোগ করার তিন বছরের কিছু বেশি সময় পর গত ২৭ জুন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেনের সই করা এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিএমডিসি। এতে বলা হয়, কর্নেল ডা. অধ্যাপক মো. নুরুল আজিমের (অবসরপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে অভিযোগকারী আহমেদ রশীদ ও শর্মিষ্ঠা আহমেদ ভুল চিকিৎসা ও অবহেলা তাঁদের একমাত্র মেয়ে শ্রেয়সী আহমেদ ঐশীর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে কাউন্সিলে অভিযোগ করেছিলেন। কাউন্সিলের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, চিকিৎসক নুরুল আজিম অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা করেছেন।
ওষুধ সেবন শুরুর ১২ দিনের মাথায় ঐশী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এতে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। আড়াই মাস এভাবে ওষুধ খাওয়ার পর ঐশী আত্মহত্যা করে। দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর।
বিএমডিসি আরও বলেছে, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসক তানজিমা তাজরিন মূলত নুরুল আজিমের তত্ত্বাবধানে কাউন্সেলিংয়ের কাজ করতেন। এ ক্ষেত্রে অদক্ষতা, অপেশাদার আচরণ দেখানোর পাশাপাশি পেশাগত কাঠামো মেনে চলেননি। এ ছাড়া ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁর ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জ্ঞানেও উল্লেখযোগ্য ঘাটতি প্রমাণিত হয়েছে। কাউন্সিলের ২০১০ সালের আইনের আওতায় বিএমডিসি নুরুল আজিমের রেজিস্ট্রেশন পাঁচ বছরের জন্য ও তানজিমা তাজরিনের এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে; যা চলতি বছরের ২৮ জুন থেকে কার্যকর হবে। এ সময়ে চিকিৎসক হিসেবে কোথাও চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন না তাঁরা। এমনকি তাঁরা নিজেদের চিকিৎসক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না।
যা হয়েছিল ঐশীর: পড়াশোনা মনে রাখতে পারছিল না বলে চিন্তিত ছিল ১৭ বছর বয়সী ঐশী। তাই তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে, এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধগুলোই মেয়েটিকে দিয়েছিলেন চিকিৎসক। ওষুধ সেবন শুরুর ১২ দিনের মাথায় ঐশী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এতে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। আড়াই মাস এভাবে ওষুধ খাওয়ার পর ঐশী আত্মহত্যা করে। দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর। বাবা-মায়ের সংগ্রাম, প্রতিক্রিয়া: আহমেদ রশীদ তাঁর ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে এখনো চারজনের পারিবারিক ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন। ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে এটিই ছিল ঐশীর সঙ্গে তোলা তাঁদের শেষ ছবি।
আহমেদ রশীদ ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর মেয়ের মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পোস্টটি ভাইরাল হয়। ওই সময় থেকে ঐশীর বাবা-মা বলে আসছেন, ঐশী আত্মহত্যা করেনি। এখন মেয়েটিকে মেরে ফেলার প্রমাণ পেলেন তাঁরা। গত বৃহস্পতিবার বিএমডিসির চিঠি হাতে পাওয়ার পর ঐশীর বাবা ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঐশীর জীবনটা মাত্র শুরু হয়েছিল। ও চলে গেল খুব দ্রুত।…ওর এই ছোট্ট জীবনের নিশ্চয় একটা “উপলক্ষ” ছিল। সেটা হতে পারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সুস্থ চিকিৎসার অধিকার আদায় করা আর চিকিৎসাক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এগুলো বিবেচনা করলে মেয়েটির জীবন হয়তো আমাদের অনেকের চেয়ে বড় ছিল। ঐশী আর কখনোই ফিরবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই ঐশীকে ভালো রাখবেন। কেননা, ঐশী কোনো ভুল করেনি, আত্মহত্যা করেনি। ঐশী মা, ভালো থেকো। বাবা-মা-ভাইজু এতটুকুই করতে পেরেছে। আবার দেখা হবে মা।’
ঐশীর জীবনটা মাত্র শুরু হয়েছিল। ও চলে গেল খুব দ্রুত।…ওর এই ছোট্ট জীবনের নিশ্চয় একটা ‘উপলক্ষ’ ছিল। সেটা হতে পারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সুস্থ চিকিৎসার অধিকার আদায় করা আর চিকিৎসাক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
ঐশীর বাবা ও মা সুযোগ পেলেই রাজধানীর মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে বিচার পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাত তুলে মোনাজাত করতেন। বিএমডিসির চিঠি পাওয়ার পর তাঁরা মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে খবরটি দিয়েছেন। এখন এ বাবা-মা চান, তাঁদের মেয়ে যেখানে আছে, ভালো থাকুক।
বিচার পাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় শর্মিষ্ঠা আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন আহমেদ রশীদ। বললেন, ‘বিএমডিসিতে ১৬ পৃষ্ঠার অভিযোগ লিখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মেয়ের মা পাশে থেকে লিখিয়েছে। এরপর বিএমডিসি ফলোআপ করেছে। মেয়ে মারা যাওয়ার পর শিক্ষকতার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সে কোথাও যাবে না, প্রতিজ্ঞা করেছিল।’
মেয়ে হারানোর ক্ষোভ-আক্ষেপ আগের মতোই আছে এ বাবা-মায়ের। গতকাল শনিবার মোবাইলে শর্মিষ্ঠা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই বলে এসেছি, আমাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেনি, আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিল না সে। এ বিষয়ে সে তার বন্ধুদের কাউন্সেলিং করত। মেয়ে প্রথমবার যখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, তখন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথে অবাক হয়ে বারবার জানতে চেয়েছে, সে আসলেই এ কাজ করেছিল কি না। মেয়েটা অনেক শক্ত ছিল বলেই আড়াই মাস সংগ্রাম করে টিকেছিল।’
মা বললেন, ‘আমরা বিচার পেয়েছি। ঐশীর একমাত্র ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া দ্রাবিড় আহমেদ এত দিন যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছে, তা থেকে খানিকটা রেহাই পেয়েছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের মেয়েকে আর ফিরে পাব? হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসকের জন্য চিকিৎসা পেশার বদনাম হয়।’
ঐশীর মায়ের অভিযোগ, ‘কোনো চিকিৎসক ভুল করলে অন্য চিকিৎসক তা নিয়ে সোচ্চার হতে চান না। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
ঐশীর বাবা বলেন, ‘আমরা চিকিৎসককে বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ মেয়ে মারা যাওয়ার পর ওষুধগুলো নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললাম; কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
আহমেদ রশীদ জানান, প্রেসক্রিপশনে ঐশীর কোনো মানসিক রোগ আছে কি না, লেখা হয়নি। মেয়ে মারা যাওয়ার পর জানতে পারেন, চারটা ওষুধে ‘সুইসাইড ওয়ার্নিং’ দেওয়া আছে। এর মধ্যে দুটি ওষুধ কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিরাপদ নয়। তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, ড্রাগ ইন্টারেকশন; অর্থাৎ একটা ওষুধের সঙ্গে আরেকটা ওষুধ মেলালে ভয়াবহ পরিণামের কথাও চিকিৎসক জানতেন না। চিকিৎসক পরে স্বীকার করেছেন, তিনি ওষুধের প্যাকেটে যে লিফলেট দেওয়া হয়, তা-ও পড়েননি। অথচ ঐশীকে প্রতিদিন ৬ ধরনের ১৭টি ওষুধ দিয়েছিলেন চিকিৎসক।’
আহমেদ রশীদ বিএমডিসিতে অভিযোগ করার আগে এমন ওষুধ সেবনে বিশ্বে কোথাও কেউ আত্মহত্যা করেছে কি না, খোঁজ করেছিলেন। তাতে জানতে পারেন, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ-সংক্রান্ত একটি মামলা চলছিল। মামলার রায় পুরোটা পড়েছেন তিনি।
আহমেদ রশীদ ফেসবুকে লিখেছেন, মামলায় জেসিকা এন রে নামের ১৬ বছর বয়সী এক মেয়েকে ওই চার ওষুধের একটি (নাম উল্লেখ করা হলো না) দেওয়ায় সে কিছুদিন পর আত্মহত্যা করে। মেয়েটিকে মাত্র একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিতভাবে এ ওষুধ প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়।
‘অভিযুক্ত চিকিৎসক বিএমডিসিতেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এমনকি বিএমডিসি থেকে ডাকলেও তিনি অসুস্থতার কথা বলে হাজির হতেন না। তাই চেম্বারে তখন তিনি যে রোগী দেখেছেন, এমন প্রমাণও দিই বিএমডিসিকে’, বললেন আহমেদ রশীদ।
আহমেদ রশীদ বিএমডিসির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসাসংক্রান্ত অভিযোগের জন্য দেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিএমডিসি। ভুল চিকিৎসার শিকার হলে ভুক্তভোগী পরিবার যেন চিকিৎসকদের গালিগালাজ না করে বিএমডিসিতে অভিযোগ করেন। আর চিকিৎসকেরা যেন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা বা অযতœ না করেন, এ আহ্বান জানান তিনি।
মানসিক রোগ হলে সবাই যাতে চিকিৎসা করান, এ আহ্বান জানানোর পাশাপাশি ওষুধ সেবনের আগে এর সঙ্গে থাকা লিফলেট পড়া, প্রয়োজনে অন্য চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়ার কথাও বলেন আহমেদ রশীদ।
আহমেদ রশীদ এখন ভুল চিকিৎসা, ডেঙ্গু, করোনা বা অন্য কোনো কারণে সন্তান হারানো বাবা-মাকে খুঁজে বের করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন, বাড়িতে যান। বলেন, ‘সন্তান হারানো বাবা ও মায়ের আলাদা ভাষা থাকে। সে ভাষা শুধু আমরাই বুঝতে পারি। তাই ফেসবুকে বা অন্য কোনো মাধ্যমে খবর পেয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি।’
‘ঐশী বাড়ি’: ঐশী মারা যাওয়ার পর আহমেদ রশীদ ও তাঁর স্ত্রী মেয়ের কবরের নাম দিয়েছেন ‘ঐশী বাড়ি’। স্থপতি বন্ধু নিশাতের সহায়তায় কবরটিকে নকশা করে সাজিয়েছেন। স্যামুয়েল মল্লিক নামের এক স্বজন ঐশীর এপিটাফ লিখে দিয়েছেন। তাতে লেখা আছে,
‘চোখের লোনাপানিতে ভেজা এই সবুজ চত্বরে
ঐশী, তুমি ঘুমিয়ে থেকো নির্ভয়ে পরম আদরে।
একটু দাঁড়াও, হে পথিক! যাচ্ছ এ পথ মাড়িয়ে
দোয়া করো মেয়েটির জন্য ক্ষণিকতর দাঁড়িয়ে।’
বাসরলতা, জুঁই, বেলি, নীলমণি, দোলনচাঁপা, গোলাপ, রক্তকরবী, হাসনাহেনা, শিউলি, কামিনী আর লতাবাহারে সাজানো ‘ঐশী বাড়ি’তে গিয়ে এখন আর ঐশীর বাবা-মাকে বিচার না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। তবে মেয়েটা যেন ভালো থাকে, প্রথম আলোর মাধ্যমে সবার কাছে ও দোয়া চাইলেন সন্তান হারানো এই বাবা-মা। -প্রথমআলো অন লাইন