বাংলাদেশের গণমাধ্যম এক ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে । গণমাধ্যমের টুটি চারদিক থেকে এমনভাবে চেপে ধরা হয়েছে যে, এর স্বাধীনতা এখন প্রায় বিপন্ন। সত্য যাতে প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য গণমাধ্যমকে হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও নির্যাতন তো চলছেই, এমনকি কথায় কথায় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের প্রধান হাতিয়ার এখন মামলা।কথায় কথায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের জেলে ঢুকানো হচ্ছে। অন্যদিকে একের পর এক কালা কানুন করে গণমাধ্যমের হাত-পা এমন ভাবে বেঁধে ফেলা হয়েছে, নড়াচড়া করার উপায় নেই। ফলে গণমাধ্যম এখন আর সত্য তুলে ধরতে পারছে না । তাই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গণমাধ্যমে খুব একটা দেখা যায় না। এতে গণমাধ্যম দিন দিন জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। আর বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে পাঠক বা সমর্থক প্রত্যাখ্যান করে। বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহ কমে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার, নিউজ পোর্টাল তথা গণমাধ্যম ।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকায় নেমেছে। বাকি ৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থের বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেল, ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। এভাবে অব্যাহত আয় হ্রাসের কারণে প্রচলিত গণমাধ্যম অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ কমাতে জনবল কমিয়ে দিচ্ছে, অভিজ্ঞ ও বেশি বেতনের কর্মীদের বিদায় করে নিয়োগ দিচ্ছে স্বল্প বেতনের অনভিজ্ঞদের । অনেক মিডিয়া হাউজ নিয়মিত বেতন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে । কোনো কোনো মিডিয়ায় বকেয়া বেতন জমে গেছে ২ বছর পর্যন্ত ।সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ভিন্নমতের বলে পরিচিত গণমাধ্যম।
এদিকে গণমাধ্যমকে কব্জায় নিতে সরকারি বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২ হাজার প্রচার সংখ্যার পত্রিকাকে ২ লাখ দেখানো হচ্ছে-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে। সংসদে ডিএফপির এই তালিকা প্রকাশও করা হয়েছে । এই তালিকা দেখে শুধু সাংবাদিকদের মধ্যেই নয়,সচেতন মহলেও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি হিসাবে প্রচার সংখ্যায় প্রথম দিকে রয়েছে, এমন কিছু পত্রিকার নাম জিজ্ঞেস করা হলে সাধারণ পাঠক তো দূরে থাক, সংবাদপত্র হকাররাও চিনতে পারেন না । আবার প্রচার সংখ্যায় সামনে সারির পত্রিকাকে সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন না করায় ৩০-৪০ নম্বরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে এই পত্রিকাগুলোর বিজ্ঞাপন রেট কমে যাচ্ছে । অন্যদিকে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক পত্রিকা ছাপিয়ে ‘বগল সম্পাদকরা মন্ত্রণালয় ও ডিএফপিতে বিতরণ করে লাখ লাখ কপি গায়েবি প্রচার সংখ্যা এবং সর্বশেষ ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন, ক্রোড়পত্র হাতিয়ে নেয়ার কারণে মূলধারার পত্রিকাগুলোর উপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে । একদিকে গণমাধ্যমের আয় কমে যাওয়ার চাপ অন্যদিকে প্রকাশ না করেও লাখ লাখ কপি প্রচার সংখ্যা, এমন বাস্তব পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে জনবল কমিয়ে পত্রিকা চালাতে হচ্ছে।
গত দেড় দশকে বেশ কিছু টেলিভিশন, রেডিও চালু হয়েছে। কিন্তু রেডিও টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কেই মূল বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে । বিগত বছরগুলোতে যারা টেলিভিশনের লাইসেন্স পেয়েছেন বা ক্ষেত্র বিশেষে পুঁজির যোগান দিয়ে মালিকানা হস্তগত করেছেন, তাঁরা সবাই সম-মতাদর্শী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী। আবাসন ব্যবসায়ী, তৈরি পোশাক শিল্প মালিক, ওষুধ শিল্প মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ী, শীর্ষস্থানীয় ঋণ খেলাপি- কেউই বাদ পড়েননি এই তালিকা থেকে। আর বাস্তবতা হলো ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকেই মালিকপক্ষ গণমাধ্যমকে বাধ্য করে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম প্রায়শই ব্যবহৃত হচ্ছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মালিকপক্ষের হয়ে দরকষাকষিতে। এই দরকষাকষি বেশ কার্যকর, কারণ এই ব্যবসায়ীরাই আবার রাজনৈতিক দলগুলোকে মোটা অঙ্কের অনুদান দিচ্ছেন অথবা নিজেরাই রাতারাতি রাজনীতিবিদ বনে যাচ্ছেন। তাদের অনেকে সরকার বা তাদের বিটীমের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন।এমন বাস্তবতায় তাঁবেদারীকেই সাংবাদিকতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ফলে সংবাদ মাধ্যম গুলো তাদের গণমূখী চরিত্র হারাচ্ছে।
গণমাধ্যম মালিকদের মধ্যে যারা সরকার দলীয় না বা সরকার ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ফরমায়েশ পালন করতে চান না, তাঁরা সরকারের রোষানলে পড়ে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আপসের পথ বেঁচে নিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকলও; আপস করে না চলার কারণে চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, সিএসবি টেলিভিশন, দৈনিক আমারদেশ, দৈনিক দিনকাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।শুধু তা-ই নয়, সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন না এমন সাংবাদিকদের বিশেষ বাহিনীর নির্দেশে চাকরিচ্যুত অথবা সাংবাদিকতায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এদের মধ্যে অনেক তারকা সাংবাদিকও রয়েছেন। উপায় না দেখে অনেক সাংবাদিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। অনেক তারাকা সাংবাদিক এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ কর্মকর্তার চাকুরি নিয়েছেন। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন।
গণমাধ্যমের আরেকটি সঙ্কট হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থার চাপের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর টিভিগুলো প্রচার করতে পারছে না । বিশেষ করে বিরোধীদলের নিউজগুলো দেখাতে হচ্ছে দায়সারাভাবে। ফলে বেসরকারি সব টেলিভিশনের নিউজ, টকশো বা অন্য অনুষ্ঠান সবই একই রকম । কোনো টেলিভিশনের আলাদা বৈশিষ্ট্য বের করা দুরূহ হয়ে পটকশোতে কারা যাবেন, কাদের নেয়া যাবে না সেটিও সংস্থা গুলো ঠিক করে দেয়। আবার বিভিন্ন সংস্থা বিরোধীদলের বিরুদ্ধে মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করে দিয়ে তা প্রচারে বাধ্য করছে। কোন নিউজ যাবে কোন নিউজ যাবে না সেটি তারা ঠিক করে দিচ্ছে।
কিছু কিছু টেলিভিশন এখন অনেকটা সরকার ও সরকারদলীয় প্রচার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফলে মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এসব টেলিভিশন থেকে । তাছাড়া যেসব নিউজ টিভিগুলো দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না সেগুলো জনগণ সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে দেখছে । ভালো বা ভিন্ন কিছু না পেয়ে মানুষ ভারতের টেলিভিশনগুলোর দিকে ঝুঁকছে এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । আরো একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয়ে টেলিভিশনের লাইসেন্স নেওয়ার পর ওই ব্যক্তি/ব্যবসায়ী স্রেফ অন্য ব্যবসার ঢাল হিসেবে তার মিডিয়া চালু রাখছেন। তাই এতে বড় বিনিয়োগ না করে কোনোভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চালু রাখছেন তারা।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিড়ের মাঝেও সংবাদপত্র আস্থা নিয়ে টিকে ছিল । কিন্তু সরকারের নানামুখী চাপের কারণে সংবাদপত্র শিল্প এখন বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে । এখন অনেক ক্ষেত্রেই সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। এ সমঝোতার কারণে এখন করতে হচ্ছে সেলফ সেন্সরশিপ। সেলফ সেন্সরশিপের কারণে অনেক নিউজ পত্রিকায় দেখা যায় না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউবে এমনকি বিদেশী গণমাধ্যমের সেসব নিউজ দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। বিদেশী গণমাধ্যমে প্রচারিত বাংলাদেশের নিউজ আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পাচ্ছে ।
নির্যাতন ছাড়াও সরকার গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগের কোনো পন্থাই বাদ রাখেনি। সরকারের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে কোনো কোনো পত্রিকায় বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ।২০১৫ সালে দেশের দুটি বড় টেলিকম কোম্পানিসহ অন্তত ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারকে বিজ্ঞাপন না দেওয়ার নির্র্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে দুটো সংবাদমাধ্যমই বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। সে র্নির্দেশনা অব্যাহত আছে।
২০১৬ সালে দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও মানহানির অভিযোগে ৮০টিরও বেশি মামলা (তথ্য প্রযুক্তি আইনে) করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং এগুলোতে মোট ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছিল।যেসব মিডিয়াকে পুরোপুরি কব্জায় আনা যাচ্ছে না, সেসব পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নামে মামলা দিয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না । শীর্ষ নিউজ সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতার করে তাঁর উপর চালানো হয় আমানবিক নির্যাতন। দৈনিক সংগ্রামের বর্ষীয়ান সম্পাদক আবুল আসাদ ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন গাজীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখা হয়। দ্য নিউনেশনের সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। বিভিন্ন অজুহাতে মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিন, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বিডি নিউজের তৌফিক ইমরোজ খালিদী, দৈনিক সমকালের মুস্তাফিজ শফি, দৈনিক জনতার আহসান উল্লাহ, ঢাকা টাইমসের আরিফুর রহমান, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদসহ আরো অনেকে । অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য চৌদ্দটি জাতীয় পুরষ্কার পাওয়া একজন সাংবাদিককে সম্প্রতি চাকরি হারাতে হয়েছে। তিনি অত্যন্ত সফল ও জনপ্রিয় একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাভিত্তিক অনুষ্ঠানের মূল প্রতিবেদক ছিলেন। তাঁকে বিদায় করে দেওয়ার পাশাপাশি সেই অনুষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে ক্ষমতাধরদের বিরাগভাজন হয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিণতি কি হতে পারে তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে দেশের অন্যতম খ্যাতিমান একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
বর্তমান সরকারের আমলে খুন হয়েছেন অন্তত ৬০জন সাংবাদিক ।সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছেন ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। একযুগ পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকান্ডের বিচার হয় নি। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে, এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ ১০৮ বার পেছানো হয়েছে।
গণমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর পেছনে সরকার ছাড়াও কিছু কিছু মতলবী মিডিয়া বহুলাংশে দায়ী। বিশেষ করে কিছু টেলিভিশন। সরকারকে বাড়তি সেবা দেয়ার জন্য বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দকে টকশোতে ডেকে নিয়ে সহযোগী সাংবাদিকদের সহায়তায় কলঙ্ক আরোপ করতে থাকে। এভাবে পুরো আন্দোলনকে তারা অপশক্তির আন্দোলন বলে বিতর্কিত করার এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্রতী হয়। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিকে বিতর্কিত করতে কিছু টেলিভিশনে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক পরিচয় এঁটে দিয়ে কলঙ্ক আরোপ করতে থাকে। যা কোনো দায়িত্বশীল মিডিয়ার কাছে জনগণের কাম্য ছিল না। শুধু তা-ই নয়, একদিকে সরকারের নিষ্ঠুর দমননীতি, গুম, খুন, নিখোঁজ, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার। অন্যদিকে, পোষ্য মিডিয়া স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার জন্য নানাভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চালায়। তারই অংশ হিসেবে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কয়েকটি টিভিতে নির্বাচনকালীন বিরোধীদলীয় জোট নাগরিক ঐক্য ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের বেশ কিছু ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। বিরোধী দলকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তাদের নির্বাচনকালীন মনগড়া পরিকল্পনাগুলো বারবার প্রচার করা হয় । আমরা জানি, সূত্র ছাড়া কোনো সংবাদ হয় না। অথচ এসব টিভি সূত্র ছাড়া মনগড়া অথবা ফরমায়েশি সংবাদ প্রচার করেছে। এমন নোংরা কাজে যখন মিডিয়া জড়িয়ে পড়ে, তখন ওই সব মিডিয়ার প্রতি জনগণ আস্থা রাখে কি করে?
দুটি শিল্প গ্রুপ তাদের মালিকানাধীন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে নিয়মিত একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কল্পকাহিনী প্রচার করছে,তাতে গণমাধ্যমের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। ফোনে আড়িপাতা এমনিতেই নাগরিক অধিকার পরিপন্থী। অথচ সেই অনৈতিক কাজটিকে কিছু টেলিভিশন সংবাদ উপাদান হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এসব ফোনালাপকে নাশকতা পরিকল্পনার ট্রিটমেন্ট দিয়ে, অভিযুক্তদের কোনো বক্তব্য ছাড়াই একতরফা প্রচারকে অনৈতিক ও দালালী ছাড়া আর কি বলা যায়? কারণ এই আলাপগুলো সব একপক্ষীয়, এগুলোর সব সুবিধা সরকার পেয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিরোধী দল। এসব দালাল মিডিয়া নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের পরিকল্পনা কিভাবে দিনের ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করে রাখবে, কিভাবে নির্বাচনে বিরোধী দলের কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে, কিভাবে প্রার্থীদের গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হবে, কিভাবে প্রশাসনকে ভোট ডাকাতির কাজে ব্যবহার করবে এসব কিন্তু প্রচার করেনি । এমনকি ভোট ডাকাতির যথেষ্ট ডকুমেন্টস থাকার পরও তা প্রচার করা হয়নি। ব্যালট বক্স ছিনতাই, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলের নিউজ বাংলাদেশের জনগণকে জানতে হয়েছে বিবিসি নিউজসহ বিদেশী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের উপর যে নিষ্পেষণ চলছে, এটা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) ২০২৪ সালে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। প্রতিবেদনটিতে দেয়া ২০২৩ সালের স্কোর ছিল.৩৫ দশমিক ৩১। ২০২৪ সালে এসে স্কোর কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৭দশমিক ৬৪।অথচ ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয় তখনকার অবস্থান ছিল ১২১। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। গত বছরের তুলনায় সামাজিক ও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও বাকি তিনটি ক্ষেত্রে অবনমন হয়েছে।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার আলোচনায় আরএসএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে এক-পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের সংযোগ সামান্য। সংবাদ ও তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি প্রচার–প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ভূমিকাও একই। ব্যক্তিগত মালিকানায় তিন হাজার প্রিন্ট মিডিয়া (দৈনিক ও সাময়িকী), ৩০টি রেডিও স্টেশন, ৩০টি টিভি চ্যানেল ও কয়েকশ নিউজ সাইট রয়েছে। স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চলা বা বিরোধীদের মালিকানায় কোনো টিভি চ্যানেল নেই। দেশটির শীর্ষস্থানীয় দুটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি মেনে চলে।
আরএসএফের ভাষ্যমতে, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী–সমর্থকেরা পছন্দ না হলে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা চালিয়ে আসছে। কোনো সাংবাদিককে চুপ করিয়ে দিতে বা সংবাদমাধ্যমকে বন্ধ করতে বিচারিক হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের বৈরী পরিস্থিতিতে সরকারি ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বিষয় সম্পাদকেরা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হয়েছে, তারও সমালোচনা করেছে আরএসএফ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগই হয়েছে এদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করা বড় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাঁরা নিজেদের সংবাদমাধ্যমকে দেখেন প্রভাব বিস্তার ও মুনাফা তৈরির একটি হাতিয়ার হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এমন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন থেকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়টি দেশ। সম্প্রতি দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের এক বৈঠক থেকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। নয়টি দেশ হলো : যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড ।
কথায় কথায় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, নির্যাতন, খুন, গুম, চাকরিচ্যুতি গণমাধ্যম শিল্পে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। যা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
ছাত্রলীগের পদবাণিজ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশের প্রায় আড়াই মাস পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মানহানি মামলার আবেদন করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা। বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে রিপোর্টার পাভেল হায়দার চৌধুরী ও প্রকাশক মাহির আলী খান রাতুলকে হাজির হতে সমন জারি করেছেন আদালত।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন রাঙামাটির সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনুর মেয়ে নাজনীন আনোয়ার।তারা হলেন, দীপ্ত টিভির বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক অনির্বাণ শাহরিয়ার, দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক ফজলে এলাহী, জাগো নিউজের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি সাইফুল হাসান, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি দিদারুল আলম ও বণিক বার্তার প্রতিনিধি প্রান্ত রনি।
‘মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদের লাভের টাকা কে খায়? এবং নিঃস্ব অনেক ব্যবসায়ী, একই দোকান দুবার বিক্রির পাঁয়তারা শিরোনামে ২টি প্রতিবেদন প্রচার করে নাগরিক টেলিভিশন। এই সংবাদ তৈরিতে তথ্য অধিকার আইন মানা হয়নি বা সংশ্লিষ্ট সকলের বক্তব্য নেওয়া হয়নি—এমন অভিযোগে নাগরিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংসদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এভাবে প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
এ ছাড়াও গুম, খুন, বিনা বিচারে হত্যা, বিরোধী দল ও মতের ব্যক্তিদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার ও হয়রানি, ফোনে আড়িপাতা এবং সুবিধামতো সেগুলো জনসমক্ষেপ্রকাশ, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, শিক্ষা ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন, প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শহিদুল আলমকে গ্রেফতার ও কারাগারে প্রেরণ, ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে গুম, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার, তাঁর উপর আদালতে প্রকাশ্যে হামলা, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন, পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া এবং পত্রিকা অফিসে ‘রহস্যময় আগুনে সকল ডকুমেন্ট নষ্ট করে দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট আহমদ কবির কিশোরকে ১০ মাস আটকে রাখা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে তার উপর ভয়াবহ নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু, যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান, লেখক ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহারকে গ্রেফতার ও নির্যাতন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামির ভাইয়ের উপর ঢাকায় হামলা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোনকে গ্রেফতার, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে হেনস্তা, গ্রেফতার এবং রিমান্ড, ঢাকা টাইমস সম্পাদক আরিফুর রহমানকে গ্রেফতার করে মানষিক নির্যাতন করা হয়েছে । দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, আমার দেশ সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, ইটিভির সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে গ্রেফতার, একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটো সাংবাদিক (৭৪র দুর্ভিক্ষকালে বস্ত্রের অভাবে বাসন্তীর জাল পেঁচিয়ে ইজ্জত রক্ষার ঐতিহাসিক ছবি যিনি তুলেছিলেন) আফতাব আহমদকে হত্যা, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা, সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি হত্যা, দৈনিক দিনকাল, আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টেলিভিশন, সিএসবি বন্ধের মতো ঘটনা সার্বিকভাবে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে । যা শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, সাধারণ মানুষকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ থেকে বিরত রাখছে ।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বক্সে ভর্তি করে ক্ষমতা দখলের পর দেশে একদলীয় কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে; যা এক ভীতিকর ও চরম অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রস্ত পরিবেশের জন্ম দিয়েছে ।২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর মত প্রকাশে স্বাধীনতার পরিসরকে একেবারেই সঙ্কুচিত করে ফেলেছে । অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁচেছে যে, সম্প্রতি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধানি প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর পুলিশ গণমাধ্যমকে হুমকি প্রদান করে। পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতি দিয়ে এ হুমকি দেয়। তারা গণমাধ্যমকে সতর্ক করে যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে সাংবাদিকদের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকিও রয়েছে।যা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভূত। পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত ও ‘নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে দাবি করে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কিছু মিডিয়া হাউজ ব্যক্তিগত আক্রোশ ও নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছে—যার মধ্য দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমাদের জিজ্ঞাসা, কোনো একটি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে সেটি কীভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করে? তার মানে এই নয় কি, তারা দুর্নীতি করেই যাবে গণমাধ্যম কিছুই লিখতে পারবে না! আমরা তাদের কাছে জানতে চাই,’ব্যক্তির অপরাধের দায় কি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের?
আমরা আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বিবৃতির একদিন পরই গণমাধ্যমে যাতে পুলিশের খবর প্রকাশের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়! চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ ধরনের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহের অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এমন নির্দেশনা দেখে মনে হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে গণমাধ্যম মহাঅপরাধ করে ফেলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন চিঠি এটাই প্রমাণ করে “রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিতে যাচ্ছে”?
পুলিশের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সদর দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার বিধানও চান পুলিশ কর্মকর্তারা। শিগগির সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে পুলিশ এই দাবি জানাবে বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে। সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের কাছে আমাদের জিজ্ঞাস্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অ্যাসোসিয়েশন যে দাবি করেছে,একইভাবে যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সংগঠন থেকেও দাবি উঠে যে, তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সদর দপ্তরের অনুমতি নিতে হবে! আর তাদের আবদার রক্ষার্থে এটি কার্যকর হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে? অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, পুলিশের মধ্যে অনেক ভালো লোকও আছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যখন মাজারের টাকা আত্মসাৎ করে, গাড়ি থামিয়ে সোনা লুট, ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, মাদক ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকে, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যবসায়িক প্রতষ্ঠানে যাওয়ার সময় টাকা ছিনতাই বা কাউকে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করে অথবা নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডার বা কক্সবাজারে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যায় জড়িত থাকে, তখন নাগরিক সমাজ এসব ঘটনার ব্যাপক নিন্দা না করে যেমন পারে না; গণমাধ্যমও প্রচার না করে পারে না।এ সমালোচনা ও নিন্দা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের প্রাপ্য।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম বিতর্কিত হন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ—যার সম্পদের পরিমাণও বিস্ময়কর। সম্পদ অর্জনে তিনি যে নজির স্থাপন করেছেন, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই বিপুল সম্পদ তিনি যে বৈধ আয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন, সেটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তা হলে বেনজীরের নজির বিহীন দুর্নীতি নিয়ে লিখার কারণে পুলিশ বাহিনীকে ক্ষুব্দ হতে হবে কেন? ঢাকার সিটি এসবিতে (নগর স্পেশাল ব্রাঞ্চ) কর্মরত অ্যাডিশনাল ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন এনএসআই কর্মকর্তা আকরাম হোসেন। যার বিরুদ্ধে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি জামিল হাসানও। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম: ‘ডিআইজি জামিল হাসান যেন আরেক ভূস্বামী। ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামানের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। শিরোনাম হয়েছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সাবেক ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম। তারা তিন কোটি টাকার সম্পদ আয় বহির্ভূতভাবে অর্জন করেছেন। পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগে দেড় কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনসহ দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জন। তাদেরবিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওসি প্রদীপের দুর্নীতি ও নৃশংসতার কাহিনি জাতি এখনো ভুলে নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপে বার বার দুর্নীতিতে শীর্ষে রয়েছে পুলিশ। দুর্নীতি করলে তা লিখাও যাবে না” – এমন আজব স্বাধীনতা বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভোগ করছে। শুধু পুলিশই নয়, এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর আগে কখনো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন একসময়ে এই কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যখন নানা সমস্যায় আর্থিক খাত টালমাটাল। বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ ধারে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংকটে পড়া কয়েকটি ব্যাংক। আবার ঋণখেলাপিদের দাপট আগের মতোই আছে। এমন পরিস্থিতিতে অপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক একত্রকরণ শুরু হয়েছে। সাংবাদিকদের দাবি বড় ঋণখেলাপি ও অনিয়মে জড়িত ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলোকে গণমাধ্যম থেকে আড়ালে রাখতে বর্তমান গভর্নর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হচ্ছে।
একথা প্রমাণিত যে গণতন্ত্রের শত্রুরা গণমাধ্যমের শত্রু। এই শত্রু হচ্ছে তারা, যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে চায় এবং লুটেরাতন্ত্র কায়েম করতে চায়; তারা স্বাধীন গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ মনে করে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে । বাংলাদেশে বিদ্যমান গণমাধ্যমের সংকট নিরসনে মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই । লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবিদিক ইউনিয়ন