শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা সঙ্কট: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ও সহায়তা কমছে

কাদের গনি চৌধুরী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

মন্তব্য প্রতিবেদন

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও আর্থিক সহায়তা দিন দিন কমছে। ফলে রোহিঙ্গাদের পরিসেবা দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে ঋণ করতে হচ্ছে। এবছর বিশ্ব ব্যাংক থেকে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান নিতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অনুদান কমে যাওয়ায় কক্সবাজার ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য ভাউচার তিন মাসের মধ্যে দুইবার কমাতে হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের দৈনিক রেশন ৩৩ শতাংশ কমে গেছে। শুরুতেই প্রতিমাসে তাদের দেয়া হতো জনপ্রতি ১২ ইউএস ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য সহায়তা। এরপর এটা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ ডলার। আর এখন দেয়া হচ্ছে ৮ ডলারের খাবার। রেশন কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্য হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছেন তাদের ৮ ডলার বা বাংলাদেশি ৯০০ টাকার খাবার দেয়া হচ্ছে। যা দিয়ে তিন বেলা তো দূরে থাক, একবেলাও তারা পেট ভরে খেতে পারছেন না। ভালো খাবারতো তাদের ভাগ্যেই জুটে না। তাদের শিশুরা চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানান, তহবিল এভাবে কমার কারণে ত্রাণকার্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।এতে রোহিঙ্গাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা নানাভাবে তাদের বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।
স্থানীয়রা জানান,পেটের দায়ে অনেক রোহিঙ্গা কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। টেকনাফ বন্দরসহ বিভিন্নস্থানে তারা পরিচয় গোপন রেখে স্বল্প মজুরিতে দিনমজুরের কাজ করছে। এতে স্থানীয় জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু তাদের দুর্বিষহ অবস্থা দেখে স্থানীয়রাও তাদের গোপনে কাজ
দিয়ে সহযোগিতা হচ্ছে। স্থানীয় দিনমজুররা দৈনিক ৮০০ টাকা মজুরি নিলেও অসহায় রোহিঙ্গারা তিন বেলা খাবার আর ২০০/ ৩০০ টাকা পেলেই কাজে লেগে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সাহায্য কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির ফলাফল হবে ভয়াবহ। নারী, শিশুসহ সবচেয়ে নাজুক মানুষগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

বিবিসির এক প্রতকবেদনে বলা হয়, “২০২৩ সালে জাতিসংঘ ও দাতাগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল৷ কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৪৪০ মিলিয়ন ডলার৷
২০১৭ সাল থেকে কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ তবে গত বছর রীতিমতো ধস নেমেছে৷ ২০১৭ সালে প্রত্যাশিত সহায়তার ৭৩ ভাগ, ২০১৮ সালে ৭২, ২০১৯ সালে ৭৫, ২০২০ সালে ৫৯, ২০২১ সালে ৭৩ এবং ২০২২ সালে ৬৯ ভাগ সহায়তা পাওয়া গেছে৷ আর ২০২৩ সালে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ অর্থাৎ ২০২৩ সালে সহায়তা কমায় রেকর্ড হয়েছে৷এদিকে ২০২৪ সালের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে জাতিসংঘ৷ বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এই সহায়তা চাওয়া হয়৷”

এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি অর্থায়নের আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ (United nations)। দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো সাহায্যের জন্য বার বার আহবান জানালেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান নিতে হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৪ কোটি ডলার ঋণ এবং ১৬ কোটি ডলার অনুদান।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ এবং আর্থিক সহায়তা কমায় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। গত এক বছরে সরকারের খরচ হয়েছে ১৬৯ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এতথ্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যত খরচ করছে তার ৫০ শতাংশেরও জোগান দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিমশিম খাচ্ছে। তিন হাজার ডলারেরও কম মাথাপিছু আয়ের একটি দেশ বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছে নিজের পকেট থেকে। এক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠীকে আরো এগিয়ে আসা উচিত।” বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিশ্বপরিস্থিতি বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা পরিস্থিতির কারণে সামনে সহায়তা কমতে পারে। কারণ নতুন ইস্যু সামনে আসলে দাতাগোষ্ঠীর দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। এর ফলে মানবিক সহায়তা ভাগ হয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের ওপর আর্থিক চাপ প্রবল হতে পারে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটও বাড়তে পারে।

★ ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৯০ শিশু:
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন ৯০টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। ৫ বছরের জন্ম নিয়েছে প্রায় ২ লাখ শিশু। যদিও নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার শিশুর। ফলে ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের চাহিদা। রোহিঙ্গাদের উর্ধ্বমুখী জন্মহার বাংলাদেশের জন্য যেমন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পে যত শিশু বাড়ছে, ততই রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদের বড় হতে হচ্ছে ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও চরম পুষ্টিহীনতার মধ্যে। ক্যাম্পে তাদের জন্য বিভিন্ন এনজিও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও সেটি হচ্ছে সীমিত পরিসরে। রোহিঙ্গা ভাষায় পর্যাপ্ত বই নেই। এখানকার স্কুলে বাংলা ভাষায় কাউকে পড়ানোর হয় না। রোহিঙ্গা ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁদের পাঠদান করা হয়। ডেনিশ রিফিউজিম কাউন্সিল নামে একটি এনজিওতে কাজ করেন আবু তাহের। তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জানান, এখানকার শিশুরা খুবই অবহেলিত। তারা ভালো খাবার পায় না। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না থাকায় তারা সর্দি কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া ও নিমোনিয়ায় ভোগে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন। এ ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয় তারা। তাই তাদের সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ মনে করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পাপ। জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করতে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিওর সাড়ে তিন হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। ইসলামের আলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সচেতন করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্থানীয় মসজিদগুলো মাধ্যমে কাজ চালাচ্ছে। এর ফলে এখন অনেকই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হচ্ছেন। এই কর্মসূচি কার্যকর করতে হলে বিনা খরচে তাদের কনডম ও পিল দিতে হবে। কারণ যেখানে ঠিকমতো তিন বেলা ভাত জুটছে না সেখানে রোহিঙ্গারা টাকা খরচ করে এসব কিনতে আগ্রহী হবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রত্যেক সাবালককে ২টির বেশি সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বিধিনিষেধ আরোপ করলে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অত্যধিক কার্যকর হতো। এরই মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে পরিবার পরিকল্পনায় জোর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
★ রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান অনিশ্চিত হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা:
ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৯০জন শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। এতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। কারণ যেভাবে রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে, এভাবে বাড়তে থাকলে শুধু টেফনাফ ও উখিয়া নয়, পুরো কক্সবাজার জুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
তাছাড়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে উখিয়ায় ও টেকনাফ দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ চাহিদার তুলনায় সেখানে সবজি, মাছ, মাংসসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম। তাই এখানে নিত্যপণ্য বিশেষ করে শাকসবজি, মাছ মাংসের দাম আকাশ ছোঁয়া। স্থানীয়রা মনে করছেন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয়ানের কারণে তাদের নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে এ বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। আগে এই দুই উপজেলায় যে পরিমাণ শাকসবজি ও মাছ উৎপাদিত হতো, তাতে স্থানীদের চাহিদা পূরণ হয়ে আরো উদ্বৃত্ত থাকতো। যেগুলো কৃষকরা বাইরে বিক্রি করতেন। রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে এখন জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনতো কমেছেই, চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানবেতন জীবনযাপন করতে হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের। একই ভাবে শ্রমবাজার আস্তে আস্তে রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
এ ছাড়াও টেনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দরা বাইরে বের হলে বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় তাদের নানা ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। তল্লাশির সময় তাদের প্রমাণ করতে হয় তারা রোহিঙ্গা নয়। পাসপোর্ট বানাতে কিংবা বিদেশ যেতে গেলে তাদের নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট বানিয়ে নিচ্ছে। আর এ পাসপোর্ট তৈরির জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানের ঠিকানা ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এআইডি করে দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ২৩জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃত দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩টি পাসপোর্ট ইতিমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে।
★ হুমকির মুখে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ, বন ও জীবন বৈচিত্র্য :
উখিয়ায় ও টেকনাফে এখনো তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গাবসতি। এর ফলে কৃষিজমি, পাহাড়, বন ও জীবনবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। রোহঙ্গিারা যে সব এলাকায় বসবাস করছে যে সব এলাকা ও আশপাশে টেকনাফ ও উখিয়ার.বহু পরিবার কৃষিকাজ ও মাছ ধরার পেশার নিয়োজিত ছিল। কিন্তু এখন কৃষিজমির বিশাল অংশে রোহিঙ্গারা বর্জ্য আর্বজনা ফেলছে। ফলে বহু ফসলি জমি ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে স্থানীয়দের অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন।
টেকনাফ ও উখিযায় এক সময় ছিল সবুজের সমারোহ। প্রচুর গাছপালা ছিল। এখন সেখানে সবুজ নেই, আছে অগণন ছোট খুপরি ঘর। জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন উখিয়া ও টেকনাফে ১২ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি গোসলখানা, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। এতে ২ হাজার ২৩১ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়াও এক সময় এ অঞ্চল দিয়ে এশিয়ান হাতির আবাস্থল ও বিচরণক্ষেত্র। এখন আর সেখানে হাতি খুব একটা দেখা যায় না।
★ শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট:
এক সময় এই উখিয়া ও টেকনাফ ছিল শান্ত জনপথ। এখানে প্রচুর ফসল হতো। শাকসবজি ধান হতো, সুপারি হতো, হতো প্রচুর কাঠ। মানুষ বেশ সুখের ছিল। সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে গিয়ে এই উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দাদের শান্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে। সূত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৩২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রায় তারা গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়। খুনও হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এটা স্থানীয়দের মাঝেও প্রভাব ফেলছে।একই সঙ্গে ইয়াবা ও আইসসহ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
বিবিসির এক খবরের বলা হয়, “বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর গত সাড়ে ৫ বছরে ১৬৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ক্যাম্পগুলোতে হত্যাকাণ্ড , অপহরণ, গোলাগুলি অনেকটা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।” বিবিসি আরো জানায়, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, সেটা যেন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে চান না। কারণ তাদের ভয়, কেউ ফোকাস হয়ে গেলেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হবে।”
★ বদলে যাওয়া জনপদ:
বিপুল আশ্রিত রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার এখন বদলে যাওয়া এক জনপদ। এখানে স্থানীয় জনগণের চেয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এভাবে রোহিঙ্গা বৃদ্ধিকে স্থানীয়রা বিষফোঁড়া মনে করছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় উখিয়ায় মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ জন এবং টেকনাফে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৩জন। অর্থাৎ দুই উপজেলা স্থানীয় জনসংখ্যা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯জন। আর এই দুই উপজেলায় রোহিঙ্গা রয়েছেন সাড়ে ১৪ লাখ। যা এই দুই থানায় স্থানীয় জনগণের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। ফলে এখানে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এদিকে কক্সবাজাররে ৯টি উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ জন। আর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা রয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ। যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে এক সময় কক্সবাজারে স্থানীয়রা সংখ্যা লঘুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
একটানা ছয় বছর ক্যাম্পে থাকায় এখন তারা এমন আচরণ করছে যে তারাই প্রকৃত অধিবাসী। তাছাড়া রোহিঙ্গারা তাদের মাদকব্যবসা বিশেষ করে ইয়াবা ও আইসব্যবসা এবং অস্ত্র ব্যবসায় স্থানীয়দের ব্যবহার করছে। এতে এক সময় উখিয়া ও টেকনাফ সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হওয়ায় আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিয়ে বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ। একদিকে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের বিপুল অর্থ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। ছয় বছরের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে মারা গেছে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা। শুধু এ বছরের জুন মাসে প্রায় ১২ দিনে উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে খুন হয়েছে ৯জন। এ বছরের প্রথম ৫ মাসে খুন হয়েছে ২৬ জন। এপ্রিলে খুন হয় ৪ জন, মে মাসে ৭ জন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকব্যবসা, ডাকাতি আর মানবপাচার মিলে মামলা সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ২০০টি। মিয়ানমারের দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে প্রায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। মাঝে মাঝে তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুই দেশের একাধিক চোরাচাল সিন্ডিকেট ইয়াবা ও আইসের বড় চালান নিয়ে আসছে। মাদকের টাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কিনছে ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। আধিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের মধ্যে প্রায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
এ পরিস্থিতিতে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো বিকল্প দেখছে না সমাজচিন্তকরা। তারা মনে করছেন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠাতে যতই দেরি হবে ততই বাংলাদেশকে সংকটে পড়তে হবে। স্বল্প উন্নত দেশের কাতারে থেকে বের হয়ে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে রোহিঙ্গারা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ দাতাগোষ্ঠীর অনুদান কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাওয়া দাওয়া, স্বাস্থ্য চিকিৎসা ও বাসস্থান অর্থাৎ পরিসেবার জন্য বাংলাদেশকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটা জিডিপির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে শুরুতেই যেভাবে আলোচনা হতো এখন তা অনেকটা কমে গেছে। সবার মধ্যে যেন একটা গাছাড়াভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারফলে গত সাত বছরে কার্যত একজনকেও প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের রিজিওনাল পাওয়ারগুলোর গুরুত্ব অনেক।এখানে ভারত ও চীনের ভূমিকা অত্যন্ত মূখ্য।তাদের আরো বেশি এনগেজ করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে ভারত ও চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো হয়। এ দুটি দেশ যা চাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার উদারভাবে দিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জনগনের মতামতের তোয়াক্কা করছে না। আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশ সরকার সিরিয়াস হলে এই দুই দেশের সমর্থন আদায়ে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com