মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে জ্বালানী তেলের অভাবে প্রায় দুই মাস ধরে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স চালক রুবেল মিয়া বিরুদ্ধে মাদকসেবন, জ্বালানী তেলের হিসাবে গড়মিল, রোগী ও স্টাফদের সাথে অসদাচরণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে উপজেলার গরিব ও দুস্থ রোগীদের। দীর্ঘদিন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ হওয়ার পর প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে অযৌক্তিক ভাড়া দাবি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনেরা দ্বিগুণ ভাড়ায় প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে করে মূমুর্ষ রোগীদের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রোগী নিয়ে মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত সরকারকর্তৃক নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ৪৫০ টাকা হলেও উপজেলার বেশ কয়েকজন রোগীর কাছ থেকে অ্যাম্বুলেন্স চালক রুবেল নিয়েছেন দিগুণ ভাড়া। এছাড় চলতি বছরে জুলাই মাসে মৌলভীবাজার রেফার করা এক রোগীর পরিবার ও স্বজনেরা হাসপাতালে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা না পাওয়ায় রোগী মারা যাওয়াকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক, ওয়ার্ডবয়কে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করে এবং হাসপাতালের দরজা, জানালা টেবিল ভাংচুর করে। শহরতলীর মুসলিমবাগ এলাকার বাসিন্দা আশিক আবেদীন জানান, গত বছর আমার ভাইকে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মৌলভীবাজার হাসপাতালে রেফার করলে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাই। এসময় সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালককে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে ৮৫০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। ইব্রাহিম খলিল নামের এক শ্রমিক জানান, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে রাত সাড়ে ১২টার সময় আমার চাচাকে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডাক্তাররা মৌলভীবাজার রেফার করলে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গেলে চালককে দিতে হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ টাকা। স্থানীয়রা জানান সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ থাকার কারণে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স চালকরা মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ১ হাজার পাঁচশ থেকে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন। ভোগান্তির বিষয়ে উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের জমির মিয়া বলেন, ‘গত ২৬ জুর শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আমার ছেলেকে মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ। পরে বাধ্য হয়ে ২ হাজার দুইশ টাকা দিয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে যাই। দক্ষিণ মুসলিমবাগ রামনগর এলাকার বাসিন্দা আফসার মিয়া বলেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালু থাকার সময় প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সগুলোর ভাড়ার এত ফারাক ছিল না। এখন যত খুশি ভাড়া নিচ্ছে তারা। রাজঘাট ইউনিয়রের বাসিন্দা সুশান্ত মন্ডল বলেন, গত এক সপ্তাহ আগে আমার মাকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। চিকিৎসকেরা মাকে দ্রুত মৌলভীবাজার নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে রেফার করেছিলেন। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় বেসরকারি কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সাাথে যোগাযোগ করি। তারা ২ হাজার পাঁচশ’র কমে মৌলভীবাজার যাবে না বলে জানিয় দেয়। পরে অনেক অনুরোধ করে দুই হাজার দুইশ টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে সদর হাসপাতালে যাই। শ্রীমঙ্গল উপজেলার শাহিবাগ গ্রামের বাসিন্দা তৈয়ব আলী বলেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে মৌলভীবাজার নিয়ে গেছি। এতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ে ১ এক হাজার তিনশ টাকা ভাড়া বেশি লেগেছে। তেলের কারণে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলাচল বন্ধ থাকবে এমনটা মেনে নেওয়া যায় না। জানতে চাইলে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের চালক বিল্লাল হোসেন বলেন, বর্তমানে অকটেন তেল ১৩৫ টাকা লিটার। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। তাছাড়া একেকটা গাড়ির দাম ১২ লাখ, ১৩ লাখ, ১৬ লাখ টাকা। তেলের দাম বৃদ্ধির পর ভাড়া কিছু বাড়ানো হয়েছে। তবে দুই হাজারের বেশি নেওয়ার কথা নয় বলে তিনি জানান। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সের চালক মো. রুবেল মিয়া বলেন, জুন মাসের ১ তারিখ থেকে জ্বালানি তেলের অভাবে অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ রয়েছে। পেট্রোল পাম্প বাকিতে তেল দিচ্ছে না, তাই এম্বুলেন্সটি গ্যারেজবন্দি। মাদক, তেলের হিসেবে গড়মিল, স্টাফ, রোগির স্বজনদের সাথে অসদাচরণের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এসব অস্বীকার করে চালক রুবেল বলেন আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগুলো মিথ্যা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, গত বছরে মোট ৬৩৬জন রোগী বহন করে অ্যাম্বুলেন্স। এতে সরকারের রাজস্ব ফান্ডে অর্থ জমা হয়েছে মোট ২ লক্ষ ৮৫ হাজার ২০০ টাকা। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শহরের স্টেশন রোডের সৈয়দ মাসউদুর রহমান ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার চন্ডিপদ আচার্য্য জানান, আমরা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানী তেল বাবত ৫ লক্ষ ১১ হাজার ৫৬৫ টাকা পাই। তেলের বকেয়া পাওনা পরিশোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আমরা তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছি। আমরা ৮ জুলাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বরাবর বকেয়া বিলগুলো দ্রুত পরিশোধ করার জন্য একটি চিঠিও দিয়েছি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী জানান, মন্ত্রণালয় থেকে নতুন অর্থ বছরের অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় পাম্পের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ না করায় গত জুন মাস থেকে অদ্যাবধি অ্যাম্বুলেন্স সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত অর্থ বছরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই কিস্তিতে ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অর্থ বছর শেষ হওয়ার আগেই ৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা শেষ হয়ে যায়। আর পেট্টল পাম্পে এর আগের অর্থবছরের কিছু বকেয়া ছিল তাও পরিশোধ করা হয়েছে। এবিষয়টি সিভিল সার্জন স্যারকে জানানা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে নতুন অর্থ বছরের অর্থ বরাদ্দ পেলে আবারও অ্যাম্বুলেন্স সেবা সচল হবে বলে তিনি জানান। অ্যাম্বুলেন্স চালক রুবেলের বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাদকসেবন, তেলের হিসাবে গড়মিল, দিগুণ ভাড়া, অসদাচরণসহ অন্যান্য বিষয়ে আমার কাছে অনেকেই মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন। আমি সিভিল সার্জন স্যারকে অবহিত করেছি। করোনাকালে তার বিরুদ্ধে এসব বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয় এবং পরে তা প্রমাণিত হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়। এছাড়া মাদকের অভিযোগে শ্রীমঙ্গল থানার এসআই সুব্রত তাকে একবার হাতে আটক করেন। আমি এসব বিষয় আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আবারও জানাবো। কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, চলতি অর্থ বছরে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সম্ভবত ১২ লাখ টাকা তেলের বরাদ্দ ছিল। নতুন অর্থ বছরের আগেই তেলের বরাদ্দের টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় তেল সংকটে অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া চলছে। মন্ত্রণালয় থেকে নতুন অর্থ বছরের অর্থ আসার পর পুনরায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা কার্যক্রম চালু করা হবে।