শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::

মাহামুদুর রহমানের সৈকতের হাসি মুখ ভুলবে এ জাতি কোনদিন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

‘একজন আমার ছেলের ফোনটা ধরে বলল, আপনার ছেলে মরে গেছে। তারপর সন্দ্বীপ থেকে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে কেমনে ঢাকা আসছি, নিজেও বলতে পারব না। আমি ছেলে হত্যার বিচার কারও কাছে চাই না, আমি শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দেব…।’
মাহাবুবের রহমান এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। তিনি মাহামুদুর রহমানের (সৈকত) বাবা। ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের মাথায় (মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে) সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মাহামুদুর রহমান। গত শুক্রবার নূরজাহান রোডের বাসায় মাহাবুবের রহমান পোষা বিড়াল পুটুকে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এ তো জন্তু-জানোয়ার, ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে এই বিড়ালও খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ছেলের চেয়ারে চুপ করে বসে থাকে।’ মারা যাওয়ার আগে এই বিড়ালের খাবার কিনে রেখে গিয়েছিলেন মাহামুদুর রহমান।
পরিবারের সদস্যরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছিলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘গান শট’। মাহামুদুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
১৯ জুলাই রাজধানী ছিল উত্তাল। সেদিন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন মাহাবুবের রহমান। সেখান থেকে তিনি বারবার ছেলেকে ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন। একবার শুধু ছেলে জানিয়েছিলেন, তিনি বাসার পাশে নিজেদের দোকান ‘জেনারেল স্টোরে’ আছেন। তারপর তো অচেনা একজন ফোন ধরে ছেলের মৃত্যুসংবাদ দিলেন। ছেলের মুঠোফোনটি আর ফেরত পাননি। পরিবারের সদস্যরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছিলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘গান শট’। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার মাহামুদুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
বাবার কথা যেন শেষ হচ্ছিল না। ছেলেকে কখনো নাম ধরে ডাকতেন না, ডাকতেন আব্বু বলে। ছেলেকে কখনো বকা দিয়েছেন বা রাগ করেছেন, তা-ও মনে করতে পারলেন না। বাবা সেদিনের (১৯ জুলাই) কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ করে আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়। তখন ব্যথার কারণ বুঝতে পারি নাই। এখন বুঝি, আমি তো বাপ, ছেলে মরে যাচ্ছে, তাই হয়তো তখন বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল।’
সেদিন এত দুর্যোগ নেমে আসবে ভাবিনি। জানলে তো ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতাম।
সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ মাহামুদুরের বয়স হতো ২০ বছর। বাবা বলছিলেন, এবার ঈদে ছেলে টিউশনির টাকা দিয়ে একটি শার্ট কিনে দিয়েছিল। ঈদের আগেই সেই পোশাক পরে ছেলেকে বলেছিলেন, ‘আজ থেকেই আমার ঈদ শুরু হয়ে গেছে।’
কান্নার দমকে প্রথমে কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না মাহামুদুর রহমানের মা আফরোজা রহমান। পাশে বসে মাহাবুবের রহমান স্ত্রীকে জড়িয়ে সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঈদে ছেলে মাকেও জামার কাপড় কিনে দিয়েছিলেন। দরজির কাছে জামা সেলাইয়ের জন্য আলাদা টাকাও দিয়েছিলেন। সেই জামা বানানো হয়নি এখনো।
মা জানালেন, ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে ছেলে ভাত খায়। তারপর চাবি নিয়ে দোকানে যায়। এরপর একবার শুধু বাসায় এসে ছেলে জানিয়েছিল, তার এক বন্ধুর পায়ে গুলি লেগেছে। এ কথা বলেই বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মা তখন নামাজ পড়ছিলেন বলে ছেলের সঙ্গে কথা হয়নি। আফরোজা রহমান বললেন, ‘সেদিন এত দুর্যোগ নেমে আসবে ভাবিনি। জানলে তো ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতাম।’
মাহামুদুরের বাবা জানালেন, বাসার সামনে গলিতে ছেলে ক্রিকেট খেলতেন। নিচে নেমে যখন অন্য ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখেন, তখন মনের অজান্তেই ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। তারপর যখন মনে হয় ছেলে তো নেই, তখন আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারেন না।
শাহরিনা আফরোজ আর সাবরিনা আফরোজের আদরের একমাত্র ভাই ছিলেন মাহামুদুর রহমান। দুই বোন আদর করে ভাইকে টুনা ডাকতেন। ভাই নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে সাবরিনা আফরোজ ভাইয়ের ছোটবেলার ছবি দিয়ে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘কত হাসিখুশি ছিলাম আমরা। এখন বুকে খালি হাহাকার, কী যেন নাই। নাই তো নাইইইই…। আমাদের কলিজাকে গুলি করে মারা হয়েছে।’
সাবরিনা আফরোজের মুঠোফোনে অনেকের কাছ থেকে পাওয়া সেদিনের ছোট ছোট কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ জমা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী, মাহামুদুর বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটের দিকে মারা গেছেন। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মাহামুদুর রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন ধরাধরি করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
মাহামুদুর রহমান জিমে ভর্তি হয়েছিলেন। বোনদের হাতের মাসল দেখাতেন, পাঞ্জা লড়তে চাইতেন। সেই টগবগে ভাই আজ মৃত। সাবরিনা বললেন, ‘পুলিশ গুলি করবে কেন? গুলি যদি করেই, ভাইয়ের হাতে বা পায়ে করত, তাহলেও তো ভাইটা প্রাণে বেঁচে থাকত।’
কত হাসিখুশি ছিলাম আমরা। এখন বুকে খালি হাহাকার, কী যেন নাই। নাই তো নাইইইই…। আমাদের কলিজাকে গুলি করে মারা হয়েছে।
পাশে বসা বাবা মাহাবুবের রহমান বলছিলেন, ‘আমার ছেলেটা এত লম্বা না হলে মনে হয় গুলিটা লাগত না।’
মাহাবুবের রহমান ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সৌদি আরবে কাজ করতেন। সাত-আট বছর আগে দেশে ফিরে আসেন। এক বছর ধরে দোকান থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ছেলে আস্তে আস্তে সংসারের হাল ধরবেন, সে আশায় ছিলেন বাবা।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন মাহামুদুরের পরিবারের সদস্যরা। তারপরই বলছিলেন, তাঁরা কোনো হয়রানির শিকার হতে চান না। এই কারণে ছেলের মৃত্যুর পর লাশের ময়নাতদন্ত করেননি, মামলাও করেননি।
৬৪ বছর বয়সী বাবা মাহাবুবের রহমানের চাওয়া, মোহাম্মদপুর কবরস্থানে ছেলের কবরটা স্থায়ী হোক। বোন শাহরিনা আফরোজ মোহাম্মদপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। আরেক বোন সাবরিনা আফরোজ বাসায় থাকা ভাইয়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। ব্যাগে ভাইয়ের রক্তমাখা পোশাকগুলো রেখে দিয়েছেন। শৈশব মেলা বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বাসার সামনে একটি পোস্টার লাগানো হয়েছে। তাতে মাহামুদুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি সবার কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে। মাহামুদুরের বাবা জানালেন, বাসার সামনে গলিতে ছেলে ক্রিকেট খেলতেন। নিচে নেমে যখন অন্য ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখেন, তখন মনের অজান্তেই ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। তারপর যখন মনে হয় ছেলে তো নেই, তখন আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারেন না। মাহামুদুর রহমানের সৈকতের হাসি মুখ ভুলবে এ জাতি কোনদিন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com