ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন কিংবা সামাজিক পরিসরে হঠাৎ করেই ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা, হতে পারেন ট্রমার শিকার। এ রকম কোনো ঘটনায় শারীরিকভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ভয়াবহতার আঁচে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন একজন মানুষ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করা বহু মানুষ মনের দিক থেকে ভেঙে পড়েছিলেন। আক্রমণ ও আগ্রাসনের সময়ে যত মানুষ শারীরিকভাবে আহত হন, মানসিকভাবে আহত হন তার থেকে বহুগুণ বেশি মানুষ। বর্তমানও তার সাক্ষী।
মানসিক আঘাতে কিছুদিনের জন্য যেমন বাধাগ্রস্ত হতে পারে দৈনন্দিন জীবন, কারও কারও ক্ষেত্রে আবার মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাও দেখা যায়। জীবনে মানসিক যাতনার প্রভাব পড়লে কোন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়, কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে ভালো রাখার প্রচেষ্টা চালানো যায়, সেসব নিয়েই জানালেন বিশেষজ্ঞরা।
কী ঘটে বিপর্যস্ত সময়ে? স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলছিলেন, জীবনের যেকোনো পরিসরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মানসিক চাপের সৃষ্টি হলে শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামলাতে তৎপর হয়ে ওঠে শরীর। বিপর্যয়ের প্রাথমিক সময়ে অস্থির লাগতে পারে, বুক ধড়ফড় করতে পারে, হতে পারে ঘাম, এমনকি উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও সৃষ্টি হতে পারে। নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হওয়া ব্যক্তি উদ্বিগ্ন বোধ করেন। তাঁর খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে, হতে পারে ঘুমের সমস্যা। মনমেজাজও বিগড়ে যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষক হাজেরা খাতুন জানালেন আরও কিছু বিষয়। বিপর্যস্ত সময়ে একজন মানুষ তাঁর স্বাভাবিক কাজেকর্মে মনোনিবেশ করতে পারেন না। মনোযোগের ঘাটতি দেখা যায়। বারবার ঘুম ভেঙে যেতে পারে, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নও হানা দিতে পারে। পছন্দের কাজগুলোতেও আর আনন্দ খুঁজে পান না তিনি। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। অসহিষ্ণুতাও মানসিক বিপর্যয়ের একটি উপসর্গ। সামান্যতেই বিরক্ত বা অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন বিপর্যস্ত ব্যক্তি, হয়ে পড়তে পারেন অতিপ্রতিক্রিয়াশীল। কারও কারও মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হয়। নিজের কথা দিয়ে অন্যকে আঘাত করতে পারেন কেউ কেউ। কেউ আবার কাউকে শারীরিকভাবেও আঘাত করে বসতে পারেন। কেউ কেউ নিজেকেও আঘাত করেন। এমনকি মানসিক বিপর্যয় খুব মারাত্মক হলে তাৎক্ষণিকভাবে আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথও বেছে নিতে পারেন কেউ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মানসিক বিপর্যয়ের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কেউ মন খারাপের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন থাকতে পারেন। ব্যাহত হয় দৈনন্দিন জীবন। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে দুঃসহ স্মৃতি। বারবার ফিরে আসতে পারে ভয়ংকর সময়ের ছবি। দুঃস্বপ্নে ফিরে আসতে পারে একই ঘটনা। ঘুমের সমস্যাও হয়। কর্মদক্ষতা কমে যেতে পারে, আয়রোজগারের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। হতাশায় ভুগতে পারেন তিনি। মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তির এমন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। এই ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি ভয় বা আতঙ্কের অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে সমস্যায় পড়তে পারেন। আশাহীন, ভরসাহীন একটি জীবনযাপন করতে পারেন তিনি। নিজেকে অযোগ্য কিংবা অপরাধীও মনে করতে পারেন তিনি। বিপর্যস্ত মনের অন্য উপসর্গগুলোও থাকতে পারে তাঁর মধ্যে। জীবনের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো বজায় রাখতে হিমশিম খেতে পারেন তিনি। এমনকি এগিয়ে যেতে পারেন আত্মহননের পথেও।
আপনজনদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে হবে। এমন কারও সঙ্গে কথা বলুন, যাঁকে আপনি ভরসা করতে পারেন, যিনি আপনার অনুভূতিকে তুচ্ছজ্ঞান করবেন না কিংবা এর নেতিবাচক দিক নিয়ে উপহাস করবেন না। অর্থাৎ, কথা বললে হালকা অনুভব করছেন বলে নিজের সমস্যার কথা যে কাউকেই বলতে যাবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। ব্যক্তিজীবনের খারাপ লাগার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো উন্মুক্ত পরিসরে বলা ঠিক নয়। বরং পরিবার, বন্ধু, কিংবা একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন নিজের অনুভূতি।
নিজেকে ব্যস্ত রাখুন: নিজের রোজকার দায়িত্ব সম্পন্ন করতে চেষ্টা করুন। মন খারাপ লাগছে বা অস্থির লাগছে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। নিজের যতœ নেওয়াও কিন্তু আপনার রোজকার দায়িত্বের অংশ। আবার দায়িত্বের বাইরেও অনেক কিছু করার থাকে। বাড়িতে বহু খুঁটিনাটি কাজ থাকে, যার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। [সাধারণ] কাজের মধ্যেই আপনি ডুবে থাকতে পারেন। পোষা প্রাণী, বারান্দার গাছ, বইপত্র, ঘরের পরিচ্ছন্নতা, রান্নাবান্না, সেলাই-ফোঁড়াইসহ যেকোনো দিকেই সময় দিতে পারেন। মোট কথা, ভালো থাকতে হলে আপনাকে কিছু না কিছু করতেই হবে। করার মতো কাজ খুঁজে বের করতে হবে। তাতে খারাপ ঘটনা থেকে মনটা অন্যদিকে সরে আসবে। আপনজনেদের সঙ্গে নিয়ে কিছু করতে পারেন। চুপচাপ বসে থাকলে বা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকলে মনটাকে স্বাভাবিক করতে সমস্যায় পড়বেন।
প্রশান্ত থাকার প্রচেষ্টা: শরীরচর্চা করুন রোজ। মানসিক চাপ কমবে। এ ছাড়া শ্বাসের ব্যায়াম, যোগব্যায়াম কিংবা ধ্যান করতে পারেন। ধর্মীয় আচার পালন করতে পারেন। ইতিবাচকভাবে ভাবতে চেষ্টা করুন। জীবনের বৈশিষ্ট্যই হলো গতিময়তা। সবাইকেই জীবনে কোনো না কোনো খারাপ সময় পার করতে হয়। আপাতদৃষ্টে আপনি যাঁকে চিরসুখী ভাবেন, তাঁর জীবনেও থাকতে পারে গোপন বেদনা। তাই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী বা বঞ্চিত মানুষ ভেবে কষ্ট পাবেন না। বরং উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বের করে আনার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী হোন। সুসময়ের ব্যাপারে আশাবাদী থাকুন।
পরের তরে: অন্যের জন্য কিছু করলেও আপনি নিজেকে ভালো রাখতে পারবেন। ভালো লাগার একটা অনুভূতি কাজ করবে আপনার ভেতর। ব্যথিত প্রাণের পাশে দাঁড়ান। অসহায় মানুষ এবং প্রাণিকুলের জন্য কিছু করুন। যেকোনো ছোট্ট ভালো কাজও আপনার মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে।
আপনজনের খেয়াল রাখুন: কোন ভুক্তভোগীর ওপর কেমন প্রভাব পড়বে, বয়সের ওপরও তা কিছুটা নির্ভর করে। শিশু এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি মানসিক যাতনার সম্মুখীন হলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অক্ষমতার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হতে পারে। শিশুদের বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই পরিবারের শিশু এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হলে নিজ থেকেই তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। তাঁদের মনের বিষয়ে যতœশীল হোন।
প্রয়োজনে সাহায্য নিন: নিজের কিংবা কাছের মানুষদের প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। সুস্থ হতে সবারই যে ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়, তা কিন্তু নয়। অনেক মানুষই কাউন্সেলিং সহায়তা এবং সাইকোথেরাপি নেওয়ার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের জন্য কাউন্সেলিং সেবার ব্যবস্থা করেছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কাউন্সেলিং সেবা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। লেখক: রাফিয়া আলম।