চীনের কাছে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নিয়ে দেখা দিয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত। সেই সঙ্গে মার্কিন বাজারে মন্দার জেরে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। উচ্চ বেকারত্ব এবং ঋণের চাপের মধ্যেই দেশে শুরু হয় চাকরিতে কোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাপক আকার ধারণ করে। যার জেরে সোমবার দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা । একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা হবে, যা নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে পারে। ইতিমধ্যেই দেশের সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। এই আবহে এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেইজিং বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এতে বলা হয়েছে, ‘একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং কৌশলগত অংশীদার হিসাবে, চীন আন্তরিকভাবে আশা করে যে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যে সামাজিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করবে। বিশৃঙ্খলতার মধ্যে হাসিনার প্রস্থান ঠিক এমন এক সময়ে, যখন বৈশ্বিক বাজারগুলি নানাকারণে উদ্বেগে ভুগছে। বিশেষ করে মার্কিন বাজারে মন্দা এই উদ্বেগ আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই আর্থিক অস্থিরতা কিছু স্বল্প-আয়ের দেশের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতার উপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, পাশাপাশি তাদের প্রধান ঋণদাতা যেমন চীনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
ঢাকা-ভিত্তিক ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাপান ও রাশিয়ার পর চীন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে বেইজিং।
জুলাই মাসে হাসিনার চীন সফরের কিছু আগে তিনি অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছিলেন। এরমধ্যেই জুনে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। চীনের কাছ থেকে এবিষয়ে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে খবর , অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ১ বিলিয়ন ইউয়ান (১৪০ মিলিয়ন ডলার ) অফার করে বেইজিং ।
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর লিন মিনওয়াং বলেন, হাসিনার পদত্যাগ বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বেইজিংয়ের প্রতি দেশটির পরবর্তী প্রশাসনের নীতি কী হবে তাও স্পষ্ট নয় ।
চীন কয়েক বছর ধরে হাসিনা সরকারকে সমর্থন করেছে এবং শেখ হাসিনা বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে কঠোরভাবে দমন করেছে। যদি ধরে নেয়া হয় বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে, তাহলে হাসিনার প্রতি চীনের অতীত সমর্থন পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে বলে মনে করেন লিন। তা সত্ত্বেও, লিন জানাচ্ছেন বিএনপি ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের চেয়ে পাকিস্তান ও চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। চীন বছরের পর বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে আলোচনা করেন। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মঙ্গলবার গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বিশ্বব্যাংক সোমবার বলেছে যে, তারা বাংলাদেশের সাথে ঋণ কর্মসূচিতে দেশের বর্তমান ঘটনাগুলির প্রভাব মূল্যায়ন করছে। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের কাছে ১৯.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা সহ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গত বছর প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশটি প্রতি বছর চীনের কাছে ২৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সুদ পরিশোধ করছে।
এডিবির সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ তথা সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো জয়ন্ত মেনন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কীভাবে চীনের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলবে তা বলার সময় এখনো আসেনি , কিন্তু এই মুহূর্তে এটির কোনো বাস্তব প্রভাব নেই বলে মনে হচ্ছে।
মেনন বলেন-‘এগুলো হল সর্বজনীন বাধ্যবাধকতা যা যে কোনও নতুন সরকারকে পালন করতে হবে, যদি তারা বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে চায়। ‘
একই সময়ে, চীন তার অর্থনীতিতে উচ্চ চাপের মধ্যে রয়েছে, সম্পত্তিজনিত সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি গতি হারিয়েছে। চীন উন্নয়নশীল দেশগুলির অন্যতম প্রধান তহবিল প্রদানকারী। অরফউধঃধ অনুযায়ী, চীন ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে১৬৫টি নি¤œ-আয়ের এবং মধ্যম আয়ের দেশে প্রায় ২০,০০০টি প্রকল্পের জন্য ১.৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার অনুদান এবং ঋণ দিয়েছে। ইউএস ফেডারেল রিজার্ভের হার বৃদ্ধির ফলে বিশ্ব আর্থিক বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় কিছু দেশ চীনের দিকেও ঝুঁকছে, কম আয়ের দেশগুলির জন্য মার্কিন ডলার-নির্ধারিত ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু চীনকে ঋণ প্রদানে ক্রমবর্ধমানভাবে সতর্ক হতে দেখা গেছে, তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে অবকাঠামোতে বড় ব্যয় থেকে ফোকাস ছোট ‘উচ্চ মানের’ প্রকল্পে স্থানান্তরিত হয়েছে ।গত মাসের তৃতীয় প্লেনামে (একটি সমাবেশ যা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে) কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিকল্পনার প্রধান দিকনির্দেশনা হিসাবে সবুজ এবং ডিজিটাল প্রকল্পগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে । দুই বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ যেটি এমন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । ২০২২ সালে তৎকালীন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে – যার পরিবারকে বেইজিং-বান্ধব হিসাবে দেখা হয় – অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পদত্যাগ করেছিলেন। পরের মাসগুলিতে, কলম্বো তার ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দ্বিপাক্ষিক ঋণ পুনর্গঠন করার জন্য চীন সহ প্রধান ঋণদাতা দেশগুলির সাথে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল। সিচুয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক পাং ঝংইং বলেন, ‘তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন।বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও ততটা খারাপ নয়, যদিও এর নিজস্ব সমস্যা রয়েছে , যার জন্য হাসিনাকে দায়ী করা হচ্ছে ।’