হিংসা কত যে মারাত্মক হতে পারে, তা শুধু যারা নিপতিত হয়েছে তারাই জানে। হিংসার আগুনে জ্বলে কত মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। কত পরিবার দুর্বিষহ জীবনের শিকার হয়েছে তার হিসাব আল্লাহই ভালো জানেন। আর আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন বলেই এ ধরনের হিংসুক থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেছেন। আল কুরআনের অত্যন্ত পরিচিত একটি সূরা হচ্ছে সূরা ফালাক। মোট পাঁচটি আয়াত দিয়ে গঠিত সূরাটিতে প্রথমে বলা হয়েছে- ‘বলো! আশ্রয় চাচ্ছি আমি প্রভাতের রবের।’ (আয়াত-১) এভাবে ২, ৩ ও ৪ নং আয়াতে কয়েকটি বিষয়ের আশ্রয় চাওয়ার পর সর্বশেষ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘এবং (আমি মহান রবের আশ্রয় চাই) হিংসুকের ক্ষতি থেকে যখন সে হিংসা করে।’ (আয়াত-৫) অর্থাৎ হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট বা ক্ষতি থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। মানব চরিত্রের যেসব খারাপ অভ্যাস আছে তার মধ্যে হিংসা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকজীবনে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, দ্বন্দ্ব ও কলহ-বিবাদ শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষময় ও দুর্বিষহ করে তোলে।
তাফসিরকারকরা হিংসার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, হিংসার মানে হচ্ছে, কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ, শ্রেষ্ঠত্ব বা গুণাবলি দান করেছেন তা দেখে কারো মধ্যে জ্বালা অনুভব করে এবং তার থেকে এগুলো ছিনিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেয়া হোক অথবা কমপক্ষে তার থেকে সেগুলো অবশ্যই ছিনিয়ে নেয়া হোক এ আশা করতে থাকা। তবে কোনো ব্যক্তি যদি আশা করে, অন্যের প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছে তার প্রতিও তাই করা হোক, তাহলে এটিকে হিংসার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।
আয়াতে হিংসুক যখন হিংসা করে অর্থাৎ তার মনের আগুন নেভানোর জন্য নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেই অবস্থায় তার অনিষ্টকারিতা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। কারণ, যতক্ষণ সে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না ততক্ষণ তারা জ্বালাপোড়া তার নিজের জন্য খারাপ হলেও যার প্রতি হিংসা করা হচ্ছে তার জন্য এমন কোনো অনিষ্টকারিতায় পরিণত হচ্ছে না, যার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া যেতে পারে। তারপর যখন কোনো হিংসুক থেকে এমন ধরনের অনিষ্টকারিতার প্রকাশ ঘটে তখন তার হাত থেকে বাঁচার প্রধান কৌশল হিসেবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে।
আর এই সাথে হিংসুকের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আরো কয়েকটি জিনিসও সহায়ক হয় : ১. মানুষ আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে এবং আল্লাহ চাইলে কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না- এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করবে। ২. হিংসুকের কথা শুনে সবর করবে। বেসবর হয়ে এমন কোনো কথা বলবে না বা কাজ করবে না, যার ফলে সে নিজেও নৈতিকভাবে হিংসুকের সাথে একই সমতলে বা কাতারে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। ৩. হিংসুক আল্লাহভীতি বিসর্জন দিয়ে বা নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যতই অন্যায়-অশালীন আচরণ করতে থাকুক না কেন, যার প্রতি হিংসা করা হচ্ছে সে যেন সবসময় তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। ৪. তার চিন্তা যেন কোনো প্রকারে মনে ঠাঁই না দেয় এবং তাকে এমনভাবে উপেক্ষা করবে যেন সে নেই। কারণ, তার চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাওয়াই হিংসুকের হাতে পরাজয়বরণের পূর্বলক্ষণ। ৫. হিংসুকের সাথে অসদ্ব্যবহার করা তো দূরের কথা, কখনো যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায় যে, যার প্রতি হিংসা করা হচ্ছে সে হিংসাকারীর সাথে সদ্ব্যবহার ও তার উপকার করতে পারে, তাহলে তার অবশ্যিই তা করা উচিত। হিংসুকের মনে যে জ্বালাপোড়া চলছে, প্রতিপক্ষের এ সদ্ব্যবহার তা কতটুকু প্রশমিত হচ্ছে তা না ভেবেই সে তাওহিদের আকিদা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে তার ওপর অবিচল থাকবে। কারণ, যে হৃদয়ে তাওহিদের আকিদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে আল্লাহর ভয়ের সাথে অপর ভয় স্থান লাভ করতে পারে না।
সুতরাং সৃষ্টিলোকের অনিষ্টকারিতা থেকে পানাহ লাভ করার জন্য সবচেয়ে সঙ্গত ও প্রভাবশালী আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপার যদি কিছু হতে পারে, তা হচ্ছে তাদের স্র্রষ্টার কাছে আশ্রয় চাওয়া। কারণ, তিনি সব অবস্থায় নিজের সৃষ্টির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। তিনি তাদের এমন অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে জানেন যেগুলো আমরা জানি, আবার আমরা জানি না এমন সব অনিষ্টকারিতা সম্পর্কেও তিনি জানেন। কাজেই তাঁর কাছে আশ্রয় হবে, যেন এমন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকের কাছে আশ্রয় যার মোকাবেলা করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টির নেই। তাঁর কাছে আশ্রয় চেয়ে আমরা দুনিয়ার প্রত্যেকটি সৃষ্টির জানা-অজানা অনিষ্টকারিতা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি। তা ছাড়া কেবল দুনিয়ারই নয়, আখিরাতের সব অনিষ্টকারিতা থেকেও পানাহ চাওয়া এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
অনিষ্টকারিতা শব্দটি ক্ষতি, কষ্ট, ব্যথা ও যন্ত্রণার জন্যও ব্যবহার করা হয়। আবার যে কারণে ক্ষতি, কষ্ট, ব্যথা ও যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় সেজন্যও ব্যবহার করা হয় যেমন- রোগ, অনাহার, কোনো যুদ্ধ বা ঘটনায় আহত হওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়া, সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি দ্বারা দংশিত হওয়া, সন্তানের মৃত্যুশোকে কাতর হওয়া এবং এ ধরনের আরো অন্যান্য অনিষ্টকারিতা। কারণ, এগুলো যথার্থ কষ্ট ও যন্ত্রণা। এসব অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াই মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও তার তাওহিদের দাবি।
আল্লাহই প্রকৃত আশ্রয়দাতা। আল্লাহর আশ্রয়স্থল ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আশ্রয় প্রার্থনা না করাটাই তাওহিদি বিশ^াসের অপরিহার্য অঙ্গ। মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সত্তা যেমন জিন, দেব-দেবির কাছে এ ধরনের আশ্রয় চাইত এবং আজও চায়। বস্তুবাদীরা এ জন্য বস্তুগত উপায়-উপকরণের দিকে মুখ ফেরায়। কারণ, তারা কোনো অতি প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ^াসী নয়। কিন্তু মুমিন যেসব আপদ-বিপদ ও বালা-মুসবিতের মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিজেকে অক্ষম মনে করে, সেগুলোর ব্যাপারে সে একমাত্র আল্লাহর দিকে মুখ ফেরায় এবং একমাত্র তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করে।
উদাহরণস্বরূপ মুশরিকদের ব্যাপারে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে- ‘আর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, মানব জাতির অন্তর্ভুক্ত কিছু লোক জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত কিছু লোকের কাছে আশ্রয় চাইত।’ (সূরা জিন-৬) ফিরাউন সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে- ‘নিজের শক্তি সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে সে সদর্পে নিজের ঘাড় ঘুরিয়ে থাকল।’ (সূরা জারিয়াত-৩৯) কিন্তু কুরআনে আল্লাহ বিশ^াসীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘বস্তুগত, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক যেকোনো জিনিসের ভীতি অনুভব করলে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে।’ কাজেই হজরত মরিয়ম সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘যখন অকস্মাৎ নির্জনে আল্লাহর ফেরেশতা মানুষের বেশ ধরে তাঁর কাছে এলেন তখন তিনি বললেন, যদি তোমার আল্লাহর ভয় থাকে, তাহলে আমি দয়াময় আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।’ (সূরা মরিয়ম-১৮) হজরত নুহ আ: যখন আল্লাহর কাছে অবাস্তব দোয়া করলেন এবং জবাবে আল্লাহ তাঁকে শাসালেন তখন তিনি সাথে সাথেই আবেদন জানালেন, ‘হে আমার রব! যে জিনিস সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তেমন কোনো জিনিস তোমার কাছে চাওয়া থেকে আমি পানাহ চাই।’ (সূরা হুদ-৪৭) মুসা আ: বনি ইসরাইলদের গাভী জবাই করার হুকুম দিলেন এবং তারা বলল, আপনি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন। তখন তিনি জবাবে বললেন, আমি মূর্খ-অজ্ঞদের মতো কথা বলা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।’ (সূরা বাকারাহ-৬৭)
রাসূলুল্লাহ সা: অনেক কিছুর অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। যেমন- হজরত আনাস ইবনে মালিক রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি নবী সা:-এর খিদমাত করতাম। আমি তাঁকে অধিকাংশ সময় বলতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা, দুঃখ-বেদনা, ঋণের বোঝা ও মানুষের নির্যাতন থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই।’ (সুনানে আবু দাউদ-১৫৪১, বুখারি-২৮৯৩, তিরমিজি-৩৪৮৪, নাসায়ি-৫৪৬৬)
হজরত আয়েশা রা:-এর সূত্রে নবী সা: থেকে বর্ণিত- তিনি তাঁর দোয়ায় বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুুবিকা মিন শাররি মা আমিলতু ওয়া মিন শাররি মা লাম আমালু’ অর্থাৎ- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই সেসব কর্মের খারাবি থেকে যা আমি করেছি এবং যা আমি করিনি তা থেকেও।’ (মুসলিম-৬৭৯১)
হিংসুকের পরিণতি : হিংসা হচ্ছে শয়তানের স্বভাব। কারণ পৃথিবীতে সে-ই প্রথম আদম আ:-এর সাথে হিংসা ও অহঙ্কার করেছে। সে নিজেকে আদম আ: থেকে শ্রেষ্ঠতর গণ্য করেছে, ফলে সে হিংসায় নিপতিত হয়েছে এবং আল্লাহর হুকুম মানতে অবাধ্য হয়েছে। মূলত অহঙ্কার থেকেই হিংসার জন্ম। আর অহঙ্কারীরা ধ্বংসশীল। যেমন শয়তান ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ জন্য হিংসা করা হারাম। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদের হিংসা করে?’ (সূরা নিসা-৫৪) হিংসায় নেক আমল ধ্বংস হয়। ঈমান ও হিংসা কখনো কারো ভেতর পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে না। অর্থাৎ কারো হিংসা থাকবে কিন্তু ঈমান থাকবে না অথবা ঈমান থাকবে কিন্তু হিংসা থাকতে পারবে না। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘কোনো মুমিন বান্দার পেটে আল্লাহর রাস্তার ধুলা এবং জাহান্নামের অগ্নিশিখা একত্রে জমা হতে পারে না এবং কোনো বান্দার পেটে ঈমান ও হিংসা একত্রে জমা হতে পারে না।’ (সুনানে নাসায়ি-২১৮৯)
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক