শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন

সাবেক হুইপ সামশুল হক বিচ্ছুর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

আ ন ম সেলিম (পটিয়া) চট্টগ্রাম
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের তিনবারের এমপি ও একবারের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির নানা তথ্য বের হতে শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক সময় যুবদল পরে জাতীয় পার্টি করা সামশুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আশ্রয় প্রশ্রয়ে রাতারাতি বনে যান আওয়ামী লীগ নেতা। ২০০৮ সালে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওবায়দুল কাদেরকে ম্যানেজ করে ভাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। প্রচার আছে, মনোনয়ন নিতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় নির্বাচন করার মত টাকা ছিল না তার। দলীয় নেতাকর্মীদের চাঁদার টাকায় নির্বাচন করে এমপি হওয়ার পর তাদের আর চিনতেন না তিনি। সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময় মনোনয়ন পেয়ে সহজে হয়ে যান এমপি। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। এস এম ইউসুফ, এম এ জাফর, মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সামশুদ্দিন আহমদ সহ অসংখ্য নেতাকর্মী দলের চরম দু:সময়ে আওয়ামী লীগের জন্য জীবন যৌবন উৎসর্গ করলেও দলের সুসময়ে মধু খেয়েছেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। তাদের কোন মূল্যায়ন করা হয়নি তার সময়ে। বিগত সরকারের প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য হন সামশুল হক চৌধুরী। টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য হওয়ার পর টাকার বিনিময়ে ওবায়দুল কাদেরকে ম্যানেজ করে জাতীয় সংসদের হুইপ হয়ে চমক সৃষ্টি করেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। অবশ্যই তার পাহাড় সম অনিয়ম দুর্নীতি,দলীয় নেতা-কর্মীদের অবহেলা ও মামলা মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসায় চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি। সংসদ সদস্য ও পরবর্তিতে প্রতিমন্ত্রীর মর্যদায় হুইপ হয়ে গত ১৫ বছর তিনি বেশ বেপরোয়া ছিলেন। তার হাত থেকে রেহাই পাননি নিজ দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও। সামশুল হক চৌধুরীর দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল সহযোগী ছিলেন তার ভাই,বোন,ছেলে, ভাগিনা, আত্মীয়-স্বজন সহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের নেতৃত্বে পুরো পটিয়ায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। সামশুল হক চৌধুরীর টাকার মেশিন ছিলেন এই সিন্ডিকেট। এক আওয়ামী লীগ নেতাকে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (পটিয়া) এর চেয়ারম্যান করে তার মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ থেকে কয়েক শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। পরে অবশ্যই ঐ নেতা অনিয়ম দুর্নীতির কারণে আজীবনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে বহিষ্কার হন। পল্লী বিদ্যুতের রেস্ট হাউসকে সামশুল হক চৌধুরী এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যেন এটি তার পৈত্রিক বসতবাড়ি। এমপি ও হুইপ থাকাকালীন বৈধ কোন ব্যবসা-বানিজ্য না থাকলেও রাজনীতিকে একমাত্র ব্যবসা হিসেবে বেচে নিয়েছিলেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। তিনি প্রায় প্রতিদিন পটিয়ায় থাকতেন যাতে দলের অন্য কেউ তার সিন্ডিকেটের ব্যবসা বানিজ্যে ভাগ বসাতে না পারে। নুন্যতম যোগ্যতা সম্পন্ন না হয়েও বিচ্ছু সিন্ডিকেটের সদস্যরা বদলি, নিয়োগসহ অফিস আদালতের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এদের ভয়ে প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা তটস্থ থাকতেন বলে জানান একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও তিনি রেহাই দিতেননা। বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত ছাড়াও নিজ দলের কয়েক শত লোকদেরও তিনি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এমনকি নিজ দলের নেতাকর্মীদের পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আহত করার নজিরও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেন। প্রতিটি এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়। কোন এলাকায় তার নিজস্ব লোক না থাকলে ঐ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে কোণঠাসা করার জন্য বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি থেকে দলে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এলাকা শাসনের নামে শোষণ করেছেন। অবশ্যই ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা নিজ নিজ দলে ফিরে গেছেন। বিচ্ছুর সময়ে সকল খাতে ঘুষ-দুর্নীতি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। শুধু তাই নয়, সিন্ডিকেটের কব্জায় ছিল মাছের ঘের, গবাদি পশুর খামার ও সবজি বাগান। ক্যাসিনো ব্যবসায়ও টাকা কামিয়েছেন তিনি সমানতালে। বিগত কয়েক বছর পূর্বে মিডিয়ায় ক্যাসিনোর পক্ষে মন্তব্য করে সারাদেশে ভাইরাল হয়েছেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। উন্নয়নের নামে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেন্ডারবাজী ও বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ করে কয়েক হাজার কোটি টাকার হরিলুটের বিষয়টি এখন সকলের মুখে মুখে। মাঝে মাঝে গরীব, অসহায় মানুষকে একশত, দুইশত, পাঁচশত কিংবা একহাজার টাকা দান করে, গরু-ছাগল জবাই করে মেজবান দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা নেওয়ার চেষ্টা করতেন অত্যন্ত চতুর এই বিচ্ছু। তিনি মনে করেন কয়েক হাজার কোটি থেকে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের সস্তা জনপ্রিয়তা নেওয়া যায়। সাধারণ মানুষ কিছু টাকা আর একবেলা ভালোভাবে খেতে পারলেই খুশি হয়ে যায় দুর্নীতি বিষয়টি তখন তারা আমলে নেবে না এমনটাই ধারণা ছিল তার। দলের কোন নেতাকর্মী টাকা কামিয়ে সুন্দর চললে পছন্দ করতেন না তিনি। চট্টগ্রাম শহরের রেডিসন ব্লু,আসকার দীঘির পাড়স্থ কর্ণফুলী টাওয়ার ও ঢাকার কয়েকটি অভিজাত হোটেলে ছায়া অফিসের মাধ্যমে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত সামশুল হক চৌধুরী ও তার বিচ্ছু সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জায়গা জমি দখল-বেদখল, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের এক বিশাল রাজত্ব কায়েম করা হয়। নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয় পুরো পটিয়ার। সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছুর এসব অনিয়ম দুর্নীতি সমর্থন না করায় সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাশেদ মনোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিনের কমিটি ভেঙে আ ক ম সামশুজ্জামান কে সভাপতি ও অধ্যাপক মো. হারুনর রশীদ কে সাধারণ সম্পাদক করে তার আজ্ঞাবহ কমিটি গঠন করা হয়। তার নির্দেশে এই আজ্ঞাবহ কমিটি এক রাতে পটিয়ার ১৭ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভার কমিটি এক কলমের খোঁচায় ভেঙে প্যাড সর্বস্ব নতুন পকেট কমিটি করা হয়। এদিকে গত সরকারের সময় সামশুল হক চৌধুরীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঐ সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় সরকারের উচ্চ মহল থেকে দুদককে চাপ সৃষ্টি করে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ঈগল প্রতীকে নির্বাচন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন সামশুল হক চৌধুরী। নির্বাচন চলাকালীন কয়েক দফা দলের ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন তিনি। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচা উন্নয়নের নামে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরন খাতেও কয়েক কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন সারাদেশে আলোচিত সমালোচিত এই বিচ্ছু। তার কথামত কোন অফিসার কাজ না করলে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হতো। উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলম জানান,গত ১৫ বছরে সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু মামলা-হামলা ও গ্রেফতার করে আমি সহ আমাদের অগনিত নেতাকর্মীদের যারপর নাই নির্যাতন করেছেন। মালিয়ারা ও হরিণখাইনের দুটি হত্যা মামলায় আমাদের নেতা এনামুল হক এনাম সহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়িয়ে হয়রানি করেছেন। তিনি প্রায় সময় বক্তব্যে বলেছেন পটিয়ায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করেছেন। তাহলে পটিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে ২৭৫ কোটি টাকার উন্নয়ন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে মেগা উন্নয়নের নামে মেগা হরিলুট হয়েছে। সাবেক সরকারের উচ্চ মহলের ইশারায় তাকে দুদক থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পটিয়ার জনগণ এসব মেনে নিবে না। মেগা হরিলুট সহ সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছুর সকল অনিয়ম দুর্নীতি দুদকের মাধ্যমে পুন: তদন্ত করতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com