গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নলগাঁও, প্রহলাদপুর, ডুমনী, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শাপলা বিক্রি করে বছরের কিছু সময় জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্ষা শুরুর পর শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত এসব গ্রামের অন্তত ৪০০ পরিবার শাপলা বিক্রি করেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পরিবারের পুরুষেরা বিল থেকে সংগ্রহ করেন এই ফুলটি। পরে তা প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন নারীরা। জানা গেছে, কলকারখানার কারণে বিলের পানি এখন কালচে রং ধারণ করেছে। এই পানির ওপর সবুজের ফাঁকে ফুটে আছে কোথাও লাল, কোথাও সাদা শাপলা। সাদা শাপলা স্থানীয় বাজারগুলোতে সবজি হিসেবে বিক্রি হয়। লাল শাপলা বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকার বিভিন্ন ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসুমে উপজেলার কৃষক ও দিনমজুররা বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করেন। শাপলা বিক্রি করে একজন ব্যক্তি দিনে ৫০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। কোনো পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় বর্ষাকালে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ কাজে যুক্ত হন। শাপলা ফুল সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। মৌসুমের শেষ অর্থাৎ কার্তিক মাসে তেমন বেশি পাওয়া যায় না।
তারা আরও জানান, শ্রীপুর উপজেলার নি¤œা লগুলো বৃষ্টির পানিতে এখন টইটম্বুর। বিশেষ করে উপজেলার বিলগুলোতে এখন ভরা যৌবন। এ উপজেলায় ছোট-বড় চার-পাঁচটি বিল রয়েছে। এসব বিলে শোভা পাচ্ছে সাদা ও লাল শাপলা। শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন উপজেলার দুই ইউনিয়নের চার শতাধিক পরিবার।
শ্রীপুর উপজেলার পাশের উপজেলা গাজীপুর সদর। ওই উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের গৃহিণী অঞ্জনা দাস জানান, পুঁজি বলতে ৪ হাজার টাকায় একটি নৌকা কিনেছেন। শাপলা তুলে বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। দুটি ছেলের পড়ালেখার খরচসহ সংসারের অন্য খরচও মেটাতে পারেন শাপলা বিক্রির টাকায়। একই গ্রামের অপর গৃহিণী দিপালী রানী জানান, নৌকা দিয়ে বিল থেকে শাপলা তুলে এনে কেটে রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে পারেন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বা পচে গেলে দাম কম পান। গত বছর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা থেকে ১৬০ কেজি দরে শপলা তিনি বিক্রি করেছেন।
গৃহিণী রীনা রানী জানান, তার ছেলে-স্বামী ভোর থেকেই বিলে শাপলা উঠানোর কাজ শুরু করেন। একটা নৌকা পর্যায়ক্রমে একাধিক পরিবার ব্যবহার করেন। শুকনো শাপলা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। গত ১০ বছর ধরে তারা শাপালা বিক্রি করে আসছেন। একজন নারী প্রতি মৌসুমে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। বিলের জায়গা মালিকানা থাকলেও কেউ শাপলা উঠাতে বাধা দেন না।
শ্রীপুরের নলগাঁও গ্রামের গৃহিণী শেফালী রানী জানান, কমপক্ষে চার মাস পর্যন্ত শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে শাপলা কেটে রোদে শুকাতে বিক্রিযোগ্য করতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। বিলে পানি থাকে যতদিন, শাপলা পাওয়া যায় ততদিন।
একই উপজেলার প্রহলাদপুরের কৃষক লিটন দাস বলেন, গত ১০ বছর ধরে এসব এলাকায় লাল শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রি করা হচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন ব্যক্তি অনেক শাপলা সংগ্রহ করতে পারেন। শাপলা শুকানোর পর কমপক্ষে পাঁচ কেজি হয়। পুরুষেরা শাপলা সংগ্রহ করেন। শোকানোর প্রক্রিয়া করেন নারীরা। বর্তমানে শাপলা ফুলের বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় অনেকেই শাপলা সংগ্রহের কাজ করেন। কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। গাজীপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা ফাউগান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লোকনাথ মন্ডল ও তার ভাই রৌদ্র মন্ডল জানান, সাদা শাপলা খাওয়ার জন্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। মনসা পূজায় সাদা শাপলা ব্যবহার করা হয়।
গাজীপুর মহানগরীর চতর বাজারের সবজি বিক্রেতা আব্দুল জব্বার জানান, সাদা শাপলা প্রতি আঁটি ৭ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করেন। একদিন পরপর স্থানীয়রা শাপলা তুলে বাজারে নিয়ে আসেন। শুকনো শাপলা পাইকাররা ওষুধ বানানোর জন্য বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে আসেন। এক মণ আট হাজার টাকায় বিক্রি করি।
কাপাসিয়ার পাঁচুয়া বাজার ব্যবসায় কমিটির সভাপতি আফতাব উদ্দিন জানান, সাধারণত বর্ষায় খাল-বিল, ডোবায় যখন পানি টইটম্বুর থাকে তখন শাপলা ভাসতে দেখা যায়। শুধু সৌন্দর্যই নয়, সুস্বাদু খাবার হিসেবেও শাপলার বেশ কদর রয়েছে। ডুমনী বিলে অপরূপ শোভা ছাড়াচ্ছে অগনিত শাপলা ফুল। দূর দূরান্ত থেকে প্রকৃতি প্রেমীদের অনেকেই বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে লাল শাপলার বিল দেখতে আসা শিক্ষার্থী নিশাত রহমান বলেন, ফেসবুকে এবং ইউটিউবে লাল শাপলার অনেক ছবি ও ভিডিও দেখেছি। তাই দেখতে চলে আসলাম। খুবই ভালো লেগেছে। এতো শাপলা আগে কখনো এক সঙ্গে দেখিনি। অনেক ছবি তুলেছি। তা দেখে নিশ্চয় আমার বন্ধুরাও আসতে চাইবে। নলগাঁও বিলে কথা হয় মাঝি কাজল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে এখানে কোন নৌকা ছিল না। দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখার জন্য আমি নৌকার ব্যবস্থা করি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে দল বেঁধে লোকজন আসে। তাদের বিল ঘুরিয়ে প্রতিদিন আমার প্রায় ৬০০-৭০০ টাকা আয় হয়।