রাষ্ট্রপতির অপসারণ:পরিস্থিতি সামলাতে করণীয়
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দীনের অপসারণ নিয়ে বেশ অস্থির দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ সম্ভব কি না- এ নিয়েও বিভিন্ন মহলে চলছে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মহড়া। রাষ্ট্রপতি নিজে থেকে পদত্যাগ করবেন, না কি অন্তর্বর্তী সরকার তাকে অপসারণ করবে, এটাই এখন মূল আলোচনা। রাষ্ট্রপতির থাকা না থাকা সাংবিধানিক নয়, এখন এটি রাজনৈতিক বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এই কথা বলেন। তথ্য উপদেষ্টা বলেন, আমরা সবাই জানি, একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সেইসময় বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রপতিকে রেখেই সরকার গঠন করেছিলাম। ‘কিন্তু আমাদের যদি মনে হয়, এই সেট-আপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে অথবা জনগণ এই সেট-আপে অসন্তুষ্ট, তাহলে এই সেট-আপ নিয়ে আমরা ভাবব।’ রাষ্ট্রপতি নিয়ে চলমান বিতর্ক নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না, এ প্রশ্নটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। এটা একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ তাই, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে’ এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে সেই আলোচনা ইতোমধ্যে চলছে বলেও জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত আসবে। নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, রাষ্ট্রপতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার ‘রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা’, এই তিনটি বিষয়কে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটি-ই আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি।’ সাবেক সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র সংক্রান্ত ইস্যুকে ঘিরে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চাইছেন অনেকেই। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাতভর এ নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে। তথ্য উপদেষ্টা সেই বিক্ষোভ কর্মসূচিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বঙ্গভবন বা অন্য কোথাও বিক্ষোভের প্রয়োজন নেই। জনগণের মেসেজ আমরা পেয়েছি।’ তিনি এখন সকলকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে আরো বলেন যে বর্তমানে নানা ধরনের ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে’। সেই ষড়যন্ত্রকারীরা যেন কোনো সুবিধা নিতে না পারে, সে বিষয়ে সাবধান করেন তিনি। পদত্যাগ বা অপসারণ যা-ই হোক এর প্রক্রিয়া বা তার পরবর্তীতে কী হবে দেশের সে সম্পর্কে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
পোস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির আগের ও পরের বক্তব্য নিয়ে ফরহাদ মজহার লিখেন, ‘মিথ্যাচার শুধু প্রেসিডেন্ট চুপ্পু করেছেন, এটা ঠিক না। আমরা বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এই প্রশ্ন এখন তুলতে চাই না যে, যারা গণ অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে নিজেদের হাজির করেছেন, তারাও মিথ্যাচার করেছেন। আমরা যখন প্রশ্ন করেছিলাম পদত্যাগপত্র কই? আমাদের দেখান, তখন কেন আপনারা চুপ ছিলেন? কেন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের পরম অভিপ্রায় হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন না করে আপনারা সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বানালেন? কেন চুপ্পুর হাতে উপদেষ্টা সরকারের শপথ করালেন? কেন গণ অভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন করেছেন? এই তর্ক কি এড়াবার সুযোগ আছে?’
ওই পোস্টে তিনি আরও বলেন, আমরা বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও আপনারা ফালতু উকিলি যুক্তি দেখিয়েছেন, অথচ আমাদের সংকট মোটেও উকিলি বা সাংবিধানিক সংকট ছিল না। আমাদের সংকট ছিল রাজনৈতিক। একমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই তার সমাধান সম্ভব।
পোস্টে আরও বলা হয়, আশা করব আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। এখন দয়া করে আর উকিলি চতুরতা করবেন না; সাংবিধানিক শূন্যতা কিংবা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ফালতু যুক্তি দেবেন না। জনগণের অভিপ্রায়ই আইন এবং গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের রায় দিয়েছে, আপনারা সেই ঐতিহাসিক রায় অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন। আর করবেন না। সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের
কলংক থেকে মুক্ত হবার সুযোগ হাজির হয়েছে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এখন তার সমাধান করি এবং গণ অভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাই।
সংকট অবসানে তিনি লিখেন, ‘তাহলে কী করতে হবে? চুপ্পুকে তাড়াতে হবে। তার সমর্থনে কোন জেনারেল দাঁড়ালে তাকেও অপসারণ করতে হবে। জনগণের মিত্র সাধারণ সৈনিক ও সেনা অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে হবে। যেন ছাত্র-জনতা-সৈনিকের মৈত্রীর ওপর ভিত্তি করে গঠিত গণশক্তি মজবুত হয় এবং জনগণের নতুন রাষ্ট্রশক্তি কায়েম করা যায়। সর্বোপরি আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারি, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে দমন করতে পারি এবং সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, ‘সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারের পরিবর্তে পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করতে হবে এবং অবিলম্বে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের ঘোষণা (proclamation) দিতে হবে। কোন সাংবিধানিক ‘অধ্যাদেশ’ নয়। মাহফুজ, আসিফ, নাহিদ এবং আসিফ নজরুল -এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কোন মূল্যে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। জনগণের ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়নের দায় আমাদের সকলের ওপর বর্তায়।
১. অনতিবিলম্বে কাটাছেঁড়া করা ৭২ এর সংবিধান এবং তার চরম বিকৃত রূপ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল করতে হবে। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার’ নামে কোন কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক আইনের ধারাবাহিকতা চলবে না। বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ করতে হবে।
২. অবিলম্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সাময়িক নিষিদ্ধ করতে হবে। জার্মান, ইতালি ও স্পেন ও অন্যান্য রাষ্ট্রে ফ্যাসিস্ট সংগঠন নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ব্যাতিক্রম নয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ফ্যাসিস্ট প্রবণতাও কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
৩. অবিলম্বে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণে তৃণমূল থেকে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকে রাষ্ট্র নির্মাণে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়েই স্থিতিশীলতা অর্জন, আর্থ-সামাজিক উন্নতির রূপরেখা নির্ণয় এবং সকল প্রকার ফ্যাসিস্ট শক্তি দমনের ক্ষেত্র তৈরি হবে।
৪. ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। একই সাথে তারা যেন ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবেই জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা অবৈধ ভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না।
আইনজীবীদের অভিমত:
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার প্রায় তিন মাস পর বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সোমবার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরই মধ্যে প্রেসিডেন্টকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছে। এই দাবিতে মঙ্গলবার বিকালে তারা শহিদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। তারা প্রেসিডেন্টকে পদ ছাড়তে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে গত বছরের ২৪ এপ্রিল ২২তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে তিনি জতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং এবং অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান। তবে শেখ হাসিনা লিখিতভাবে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন কিনা এই বিতর্ক ছিল।
সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুররীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়ত সময় পাননি।’
সোমবার প্রেসিডেন্ট এই কথা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে? তবে সোমবার রাতে বঙ্গভবন থেকে দেওয়া এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যান শেখ হাসিনা।
সংবিধানের ৫৭ (ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হয়। এতদিন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন বলেই ধারণা করা হয়েছে। ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানও জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। তাই এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিতর্ক ও প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ প্রসঙ্গ:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই পদত্যাগ করেছেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন যে তিনি আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। ফলে তিনি পদত্যাগ করেছেন কি করেন নাই সেই বিতর্ক খুবই অপ্রাসঙ্গিক।’
‘তবে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তার নিয়োগকারী সংসদই তো নাই। এখন তিনি তার পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ নাই। আবার অন্তর্র্বতী সরকার, যাদের তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কীভাবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন,’ বলেন তিনি।
তার কথা, ‘তবে এখন তিনি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নাই। তাই রাজনৈকি দলসহ সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে এটা হতে পারে। পরের সংসদ এসে এর বৈধতা দেবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘এখন স্পিকার নাই, ডেপুটি স্পিকার নাই। ফলে প্রেসিডেন্ট কার কাছে পদত্যাগ করবেন। এখানে একটা শূণ্যতা আছে। এইক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ডকট্রিন অব নেসেসিটি। নেসেটিটি এটাকে লিগ্যাল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার যে রায় আছে সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে। আর তাকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ নাই। যেহেতু পার্লামেন্ট নাই। পার্লামেন্ট ছাড়া তো আর অভিসংশন হবে না।’
শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিতর্ক নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আসলে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে তার পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে বলেছেন। আবার সোমবার বঙ্গভবন একটি প্রেসনোট দিয়েছে।’