ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি দেশের পক্ষের সকল শক্তিকে সজাগ এবং সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করুন, জনগণের সঙ্গে থাকুন, জনগণকে সঙ্গে রাখুন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে বিএনপি অবশ্যই বিজয়ী হবে। গতকাল বুধবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি’র উদ্যোগে ‘৭ই নভেম্বর ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভার শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। সভায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ডকুমেন্টারি দেখানো হয়।
তারেক রহমান বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। মাফিয়া সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সময় বিশ্বে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিচিত করার অপকৌশলে লিপ্ত ছিল। ক্ষমতা হারিয়ে ৫ই আগস্টের অপশক্তি এখন কিন্তু আবার বিশ্বে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সুতরাং ৫ই আগস্টের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অন্তর্র্বতী সরকারের পাশাপাশি অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষের সকল শক্তিকে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশে জনগণের আদালত এবং রাষ্ট্রীয় আদালত তথা বিচার বিভাগ শক্তিশালী, স্বাধীন এবং কার্যকর থাকলে ফ্যাসিবাদ কখনো
স্বাধীনতা এবং ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না। জনগণের আদালতের অর্থ কিন্তু বিচারিক আদালত কিংবা মব জাস্টিস নয়। জনগণের আদালতের অর্থ কোনো ব্যক্তি তার দলকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান, চূড়ান্ত ক্ষমতা হাতে ন্যস্ত থাকা। জনগণের ভোট প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ কিংবা প্রসিদ্ধ করার মতো অপ্রিয় কাজের দায়ভারও রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে না। জনগণ নিজেরাই তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে খুনি, লুটেরা, টাকা পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ে আড়ালে থাকা মাফিয়া চক্রকে প্রত্যাখ্যান করবে। যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার অবশ্যই হতে হবে রাষ্ট্রীয় আদালতে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের ভার রাজনীতির মাঠে, অর্থাৎ জনগণের দ্বারা, জনগণের আদালতে হওয়ার সংস্কৃতি চালু করা গেলে এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু করেছে উল্লেখ করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতার যথানিয়মে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে। সুতরাং বিএনপি’র সকল নেতাকর্মীকে বলতে চাই, জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করুন, জনগণের সঙ্গে থাকুন, জনগণকে সঙ্গে রাখুন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে বিএনপি অবশ্যই বিজয়ী হবে। তবে প্রত্যেক নেতাকর্মীর মধ্যে বিজয়ের আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেদের জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখবেন না। জনগণের কাছে পছন্দ নয়, এমন কোনো কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। কারণ জনগণই বিএনপি’র সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।
তিনি বলেন, জনপ্রত্যাশার বিচারে ১৯৭১ সাল, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট-প্রতিটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। প্রতিটি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
রাষ্ট্র মেরামতে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, সংস্কার একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপি সংস্কার কার্যক্রমের পক্ষে। তবে বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রথাগত সংস্কারের চেয়ে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে, রাজনীতি, রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মী, সমর্থকদের গুণগত পরিবর্তন, সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
একদিন পরেই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ তিন মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি সরকারের সাফল্য এবং ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য তিন মাস হয়তো যথেষ্ট সময় নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাজারে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিদিন যে মানুষগুলোকে হার মানতে হয়, তিন মাস সময় তাদের কাছে মনে হতে পারে- তিন বছরের সমান। তাই বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর বা স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা নি¤œমধ্যবিত্ত এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতায় মধ্যে আনতে ব্যর্থ হলে অন্তর্র্বতী সরকারের সকল সংস্কার কার্যক্রম জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।
তারেক রহমান বলেন, দেশকে আমদানিনির্ভর, পরনির্ভর এবং ঋণনির্ভর একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করে মাফিয়া সরকারের প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। পলাতক স্বৈরাচারের ১৫ বছরের দুঃশাসনের কুফল এখনো জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট পলাতক স্বৈরাচারের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে, দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশের আবহমানকালের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহত্তর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চেনার দিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৭ই নভেম্বরের চেতনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবজ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে মূল মন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের পথ সুগম হয়েছিল। এদিন থেকেই মূলত বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি জাতীয়তাবাদী ভিত্তির রাজনীতি রচিত হয়েছিল।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৭ই নভেম্বর শুধু একটি দিন নয়, দিবস নয়। ৭ই নভেম্বর দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল। নতুন সত্তা পেয়েছিল। নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সেই ইতিহাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গত ১৬ বছর ৭ই নভেম্বর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আমরা পালন করতে পারি নাই। এই দিবস জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এটা বিএনপি’র কোনো দিবস না। এই দিবসটি দেশের জনগণের দিবস। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দানব উপস্থিত হয়েছিল। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া আবার আন্দোলনে নেমেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান নাই। সেই হাল ধরেছেন তারেক রহমান।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্র্বতী সরকার সংস্কারের কথা বলছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন সংস্কারের মধ্যদিয়ে যাবে। সেই সংস্কারকে যদি একমাত্র কর্তব্য বর্তমান সরকারের কাছে হয় তাহলে ভুল হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার চাইলে মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সরকার এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। নির্বাচিত সরকারই পারে সংবিধান সংশোধন করতে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু’র সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল আহসান, বিএনপি নেতা ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, আবদুস সালাম, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, যুবদলের আব্দুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস এম জিলানী, কৃষকদলের হাসান জাফির তুহিন, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ। এ ছাড়া সভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।