কবিতা এক লীলাভূমি। সেখানে বিচিত্র ধরণের কাব্যকলার চাষবাস চলে। যেমনি রঙচটা ফুলে সেজে থাকে কানন, তেমনিই বিবর্ণ ফুলও থাকে সে কাননে। এমনটিই এক কাননের নামও কাব্য। যদিও তরল, তোষামুদে অকবিরা কাব্যের এ শিল্পকে করছে কলুষিত, দূষিত। সুরসুরি জাগানিয়া কথামালা, ফুল-পাখি ইত্যাদিই যেন শুধু তাদের কাব্য বিষয়। চোখের সামনে হাহাকার করে মরে পীড়িত, গরম কাপড়ের জন্য হন্যে শীতার্ত, বসত হারিয়ে দুর্বল যেন ঝড়ের কবলে সর্বহারা বিহঙ্গ, তা পড়ে না তাদের চোখে। ভয়, লোভ আর উচ্ছিষ্টভোগ তাদের দিয়েছে রুখে। তাই কবিতা কাঁদে না। বজ্রকণ্ঠে ভেটে পড়ে না। অসহায়ের যাতনা লাঘবে হয় না সান্ত¡না। এসব কবির যখন ছড়াছড়ি। শাসকের শাসনদ- এক্কেবারে কড়াকড়ি। তখনই নিজেকে উল্টো স্রোতের যাত্রী করে; কলম নামক হালকে শক্ত ধরে; মান-অপমান, লজ্জা-শরমের সাথে প্রাণপণে লড়ে; তুলেছেন এক কাব্য সুষমার কেল্লা গড়ে। তিনিই আমাদের ইতিহাসবোধের কবি, স্বাধীকারের জন্য উচ্চকিত কণ্ঠের কবি, নৈতিকতার পাঠদানের কবি, জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়ে সোনালী দিগন্তে নিয়ে যাওয়ার কবি, মোশাররফ হোসেন খান। কেননা, তাঁর কবিতা সমাহারে বিহার করলে আমাদের কাব্যরসিক মন ভরে ওঠে। আমরা তুষ্ট হই কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। কী নেই তাঁর কাব্য জমিনে? শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, রান্নাঘর থেকে সংসদ, পাড়া মহল্লা থেকে জাতিসংঘ, সব আলোচিত হয়েছে। কাব্য নামক সুশিল্পের দ্বারা খুঁত, আশা, নিরাশা, বোবাকান্না ইত্যাদি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মনোরমভাবে। ফিলিস্তিনের রক্তবন্যা, কাশ্মীরের ভূস্বর্গ কন্যা, কিংবা আরাকানবাসীর একটু আশ্রয়ের জন্য ধন্যা, সেই সাথে প্রকৃতি, পিতা-মাতা, আদরের সন্তান, ইহ কিংবা পর কাব্যের ঝংকারে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন শিক্ষনীয় করে। কেননা, হিত চিন্তা তাঁর মননে ভাস্বর। তাই উপর্যুক্ত উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা শতভাগই যৌক্তিক। আর তার যৌক্তিকতা নিরুপণে আমাদেরকে তাঁর কাব্য সমগ্র নামক কাননে অলি হয়ে ঘুরতে হবে। তবেই না কথাগুলোর সত্যাসত্য বিচার হবে। কবি মোশাররফ হোসেন খান একজন বিশ্বাসী মানুষ। সুশৃঙ্খল ও সবথেকে নিখুঁত জীবনব্যবস্থা ইসলামের অনুসারী তিনি। এবং ইসলামের অনুশাসন নিজ মাতৃভূমিসহ গোটাবিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হোক সেটি প্রত্যাশা করেন। জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তই তিনি মানবিক মৌল আদর্শের সাহিত্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তাঁর কাব্যে মহান স্রষ্টা রাব্বুল আলামিনের প্রসঙ্গ ও স্তুতি হামেশাই পরিলক্ষিত হয়। সাথে সাথে মানবতার মুক্তির দূত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ রাসুলে আকরাম (সা)-এর না’ত বা প্রসঙ্গ তিনি শব্দের বুননে ও উপমায় গড়েছেন। যা তাঁর কাব্যকে করেছে কল্যাণময়তার অনুষঙ্গ। যেখানে ভিন্নধর্মাবলম্বী কবি জন কীটস বলেছেন, ‘পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর তা সবই নবী মুহাম্মদ (সা)। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।’ সেখানে একজন উম্মতে মুহাম্মদি হয়ে কতোটা সৌভাগ্যের অধিকারী তা বাঙময় হয়েছে কবির কাব্যে। একজন সুকবি হিশেবে আদৃত মোশাররফ খানের কবিতায় সবচেয়ে বেশি যে অনুষঙ্গ উঠে এসেছে তা হচ্ছে জরা ভেঙে এক সাম্য ও সমৃদ্ধির দেশ, পৃথিবীর কামনা। এরকম পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছেন কবি। কারণ কল্যাণ রাষ্ট্র ছাড়া কোনও দেশের ভাগ্য সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। আর পৃথিবীতেও কখনও শান্তি ফিরে আসবে না। আর যাতে শান্তি ফিরে না আসে তার জন্য কায়েমি শক্তি উঠে পড়ে লেগে আছে। তারা বিভেদ সৃষ্টি করে দাঙ্গা বাধিয়ে ফায়দা লুটছে। আর সর্বহারা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঢল নেমেছে মাতৃকা ছেড়ে পশ্চিমে যাওয়ার। এশিয়া আজ বেশি উত্তাল। কবি হতাশার মধ্যে আশা দেখে বলছেন,‘তবুও
শুধু হাহুতাশে কেটে যাবে একটি জীবন-
তা কী করে হয়!
জীবন মানেই তো ঝড়-ঝঞ্ঝা সমুদ্র সিম্ফনি! বাইরে ঘন কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি
যতদূর চোখ যায় কেবল ধূসর
এত অন্ধকার, এতো কালো অমানিশা
এশিয়াকে আর কখনো গ্রাস করেনি’
(সাহসের সিম্ফনি) এমনি সাহস জাগানিয়া কবিতা হচ্ছে ‘সাগরে বেঁধেছি ঘর’, ‘গণহত্যা : আটাশে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩’, ‘তারুণ্যের প্রতি’ ইত্যাদি। যে কবিতাগুলো পাঠে মনে আশা জাগে কঠিন। এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় অদম্য। আবার গড়তে ইচ্ছে হয় মনের মাধুরি মিশিয়ে। তাই কবির দীপ্ত উচ্চারণ,
‘তোমার পায়ের নিচে পড়ে থাক ঘুটঘুটে কালো
যেখানে আঁধার, সেখানে জ্বালাতে হবে আলো।
যেখানে কখনো জলে না প্রদীপ, তুমি জ্বালাও ঢের
মৃত জনপদে জাগাও তরুণ নয়া জিন্দেগি ফের।
পথের কথা ভেবো না কখনো ভেবো না কতদূর?
যত দূরে যাবে তার চেয়ে দূরে যাবে দৃপ্ত সুর।
জীর্ণশীর্ণ পাতা ফেলে ফোটাও বাগানে নয়া পাতা
বজ্র কঠিন সময়ে ওড়াও সবুজ-স্বপ্ন ছাতা।’
(তারুণ্যের প্রতি/তিন)
একজন শুভাকাঙক্ষী ও কল্যাণকামী কবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি প্রেম ও মমত্ববোধ নিয়ে যাঁরা কাব্য করেছেন তারাই আজও ভাস্বর পাঠক এবং দেশের মানুষের হৃদাসনে। দেশের কথা মনে হলেই আমরা অন্যরকম অনুভূতিতে ভাসি। এরকম দায়িত্ব ও দেশপ্রেম থেকে মোশাররফ খানের কবি মানস উৎসারিত করেছে প্রোজ্জ্বল কিছু কবিতা। মধু কবির মতো সনেট লিখে তাতে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তিনি। এদেশ সত্যই অনন্যা। দেখার চোখ দিয়ে দেখলে এটা অনুভূত হবে। সেই অনুভূতিই এভাবে ব্যক্ত করেছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান।
‘সবুজ শ্যামল দেশ আমারই ভূমি
এখানে বাতাস বয় অযুত মৌসুমী
এ আমার দেশ; স্বর্ণ ফলা এই মাটি
নিয়ত নিকোনো আর পূর্ণ পরিপাটি।
পাখির কল গুঞ্জন, ডাহুকের ডাক
বিপুল বৈচিত্র্য আর প্রকৃতি অবাক।
শত ঝঞ্ঝা বুকে নিয়ে আমার এদেশ
উড়িয়ে দিয়েছে ঊর্ধ্বে বিজয়ের কেশ।’
(আমার ভূ-স্বর্গ)
একজন দেশপ্রেমিক ও বিশ্বাসী মানুষ হবেন সত্যের প্রচারক। কোনও অপশক্তির কাছে মাথা নত করবেন না বা হবেন না তাদের উচ্ছিষ্ট ভোগী হয়ে মিথ্যের ধ্বজাধারী। মোশাররফ খানও একজন দেশপ্রেমিক এবং বিশ্বাসী কবি। তাই তাঁর কাব্যের সুতীক্ষ্ম তীর ভেদ করে জুলুমবাজের জিগার। তাকে সত্য বলতেই হবে। কেননা, তিনি তো আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পান না। তিনি তো কামনা করেন না অন্য কারও সন্তুষ্টি। অন্য অনেকে ভয়ে মুষড়ে পড়লেও তিনি ঋজু তাঁর সত্য বচনে, সত্য কথনে। তাইতো তিনি সাধারণের পরিগণিত হন। থাকেন না কোনও বিশেষ শ্রেণির। দেশের ভিতরে বসন্তের সবফুলের বর্ণ ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু আজ সবখানে একটি মাত্র রঙ তা আবির। এই আবির মানে রক্তবন্যা। কত মায়ের কোল খালি। উজাড় হয়েছে কত্ত বাস্তু। দেশবাসী যেন হামেশাই শোনে জীবন হরণকারী গুলির আওয়াজ। কবি সেই সত্য উচ্চারণ করে শ্বাপদ-সংকুল দেশের প্রতিচ্ছবি আঁকছেন,
‘গুলির বিকট শব্দে জাগি বারবার,
স্বদেশ আমাকে ঘুমুতে দেয় না আর।।’
(স্বদেশ আমাকে)
গুলির মাধ্যমে বিরোধী মতকে দমনে এতটাই বেপরোয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন অন্ধশক্তি যে, হুটহাট করে নিজেদের অনেককেও নানা অজুহাতে নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না নিরীহ সাধারণও। তাই মৃত্যুপুরী আজ দেশটা। মৃত্যু নিত্য ব্যাপার। যেন ডালভাত। খুবই সস্তা। এসব তুলে ধরেন নিরপেক্ষ কবি। যার কলম কাউকে ক্ষমা করে না। সময়কে লুকিয়ে রাখেন না। কিংবা এড়িয়ে যান না। সময়কে ধারণ করে লিখেন। তাই সময়ও তাকে জীবিত রাখেন। তার এ ধরনের কাব্য পঠিত হলেই মানুষ বুঝে ফেলেন কোন সময়ের অনুষঙ্গ। আর তার আবেদন চিরকালীন হয়ে যায় প্রকাশ মাধ্যমের নান্দনিকতার জন্য। কবি মোশাররফ খান সময়কে ধারণ করে তাই বলছেন,
‘খুনও সস্তা এখানে নুনের চেয়ে’
(দানবীয় দাঁত)
সত্য উচ্চারণ শুধু দেশের বিষয় নিয়ে নয়। বরং তা পৃথিবী ব্যাপী নানা হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতা নিয়েও করেছেন কবি। কেননা, তিনি পৃথিবী গ্রহের বাসিন্দা। অন্যদেশে বসবাসরত মানুষজনও প্রতিবেশি। এই প্রতিবেশিদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন ইত্যাদি নিয়েও তিনি সোচ্চার। ব্যথিত হয়েছে তাঁর স্পর্শকাতর কবি মানস। তাই লিখছেন,
‘এখন কালের পিঠে জমেছে ধুলো
এখন পৃথিবীময় শূকর ও শৃগালের উল্লাস
এখন বারুদ ও বিষাদে উত্তপ্ত সাগর
এখন উত্তপ্ত পৃথিবী ও সৌরচুলো
এখন কালের পিঠে জমেছে ধুলো।’
(কালের পিঠে জমেছে ধুলো)
কবি যেহেতু পৃথিবী গ্রহের নাগরিক, আর মানবতাবাদী, সেহেতু তাঁর কবিতার জমিন সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনি ভাবেন সবাইকে নিয়ে। কাউকে আপন-পর ভাবেন না। এটাইতো একজন প্রকৃত কবির বৈশিষ্ট্য। যে কবি নিজেকে বৃত্ত বন্দী করেছেন তিনি সেই বৃত্তের আদরণীয় ও বৃত। কিন্তু যিনি উদার মনে বিশ্বমানবতার কল্যাণ চেয়েছেন, মানবতার জয়গান করেছেন, মজলুমের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনিতো বিশ্বমানবতার। মজলুমের। নিপীড়িতের। মোশাররফ খান সে হিশেবে একজন বিশ্বমানবতার কবি। কেননা, তিনি নিপীড়িত ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য লিখেছেন, কেঁদেছেন রোহিঙ্গাদের জন্য, ব্যথিত হয়েছেন কাশ্মীরের মানুষদের জন্য, মধ্যপ্রাচের ভাগ্যাহত মানুষের জন্য বুক ভাসিয়েছেন। এসব অনুষঙ্গ তাঁর কাব্যকে করেছে বিশ্বমানবতার। এরকম কবিতাগুলো হচ্ছে, ‘ফিলিস্তিন ২০১৪’, ‘রোহিঙ্গা উদবাস্তুদের প্রতি’, ‘মানবজাতি’, ‘শ্রমিকের রক্তভেজা ঘাম’, ‘কাশ্মীর-২০১৯’, ‘ফিলিস্তিনি শিশুর জন্য’, ‘গাজার শিশু’ ইত্যাদি। তবে শুধু লোক দেখানোর জন্য তাঁর এ মানবতাবাদ নয়। নিজেই যেন কাঁদছেন ওসব মজলুমের সাথে। নিজেই পালাচ্ছেন ঘর ছেড়ে। কিংবা রাইফেলের গুলির আঘাতে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। কবির বিশ্ব মানবতাবাদ যে কী ধরনের তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে,
‘সমগ্র পৃথিবীতে আমাদের অধিবাস
আমাদের একটিই উঠোন এবং বিচরণ ক্ষেত্র
সুতরাং আমাদের চাষবাসের মাধ্যম হোক
একমাত্র মানবতা!’
(মানবজাতি)
কবি যখন কবিতা বুনেন তখন তিনি একা। তাই বলে তার কবিতা জনবিচ্ছিন্ন নয়। কারণ তিনি কবিতা লিখেন নিজের আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদি দিয়ে। কিন্তু সেই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো যখন নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত হয় তখনই তা আর একান্তই কবির থাকে না। এ ধরনের কবিতাকে নতুন অলংকরণে প্রোফাইলধর্মী কবিতা বলা হয়। কবি মোশাররফ খানও বেশকিছু প্রোফাইলধর্মী কবিতা লিখেছেন। ঠিক সে কবিতাগুলোতেও অনেক কবির মনের ছায়া পাওয়া যায় কিংবা অনেক সাধারণের মনোব্যথা ফুটে ওঠে। কবি বলছেন তাই,
‘একা, খুব একা হয়ে আছি পত্র-পল্লবহীন কা-ের মতো
সময়ও কি সহ্য করতে পারে
মেরুদ- খাড়া কোনো কবিকে!
কিছুই বুঝি না আজকাল
কূটচক্রের বিন্দু কিংবা সিন্দুকে
তাইতো লুকিয়ে থাকি রোরুদ্যমান ঝিনুকে।’
(গোরস্থানমুখী)
এইযে, লুকিয়ে থাকা, তা কিন্তু কবির একার অবস্থা নয়। অসংখ্য মানুষকে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এখানেই কবির সফলতা যে, তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিও সাধারণের হয়ে গেছে। ঠিক যেমন আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে মানবসন্তানের অপমান। হত্যাযজ্ঞ। আর আফসোস করি। কবি কি আমাদের মনের কথা পড়ে লিখেছেন এই লাইনগুলি?
‘একেই বলে দুর্ভাগ্য!
এশিয়ার এক কোণে বসে নির্বাসনে আছি
আমি এক ভাগ্যবিড়ম্বিত কবিÑ
একাকী, নিঃসঙ্গ!’
(উপমহাদেশ)
কবি স্বাধীন। সে কারো ধার ধারে না। পরোয়া করে না কোনো রাজ রাজড়ার। বলিষ্ঠ কণ্ঠ যদি নাই থাকে তাহলে তার কবি হওয়া মানায় না। পদ পদবি না হলেও কবি থেমে থাকে না। তার আরাধ্য হয় প্রকৃতি ও মানুষ। কবি খেদোক্তি বা খেদহীন দু’ভাবেই বলেছেন সে কথা।
আবার একটা সাধারণ ধারণা জন্মেছে যে, শিল্পচর্চার মানেই নাস্তিকতাবাদ মেনে চলতে হবে; বামপন্থী বা প্রগতিশীলতার নামে প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখাতে হবে; আস্তিক হলেই সেকেলে; নারী-পুরুষের অবাধ সঙ্গ বা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে হবে। প্রকৃত অর্থে এসব ভান। শিল্পচর্চার সাথে এসবের ন্যূনতম কোনও সম্পর্ক নেই। পরিশীলিত মানুষ থেকে পরিশীলিত বিষয় আশয় জন্ম নিবে। অন্যথায় উচ্ছন্নে যাওয়ার উপকরণই প্রসব হবে। আর বেড়ে যাবে অরাজকতা। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান সময়। কবি নিজেকে পরিশীলিতের পক্ষে রেখে সমাজকে পরিশীলিত করতে চেয়েছেন। কারণ এটা ইতিবাচক বা আলোরূপী। আর যাকে ভয় পায় প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী আঁধারের ধারকরা। তাই কবি বলছেন,
‘তাহলে ‘বিশ্বাসই’ কি ওদের একমাত্র আতঙ্কের কারণ?
যেমন ভয় পায় উঁইপোকা আলোর উত্তাপ!
ওদের হৃৎকম্পনের কারণ আমি বুঝি।
কবি বলে আমাকে বুঝতে হয়।’
(প্রশান্তির উপত্যকা)
কবিকে হতে হয় বহুদর্শী। কবিকে হতে হয় বহুমুখী। কবিকে হতে হয় চিকিৎসক কিংবা গায়ক। গরুর রাখাল কিংবা সোহরাব-রোস্তম রূপী নায়ক। গীতলতায় ভর করে মিশে যেতে হয় মোহনায়? নইলে কাব্য থেকে যায় একমুখী। পানসে লাগে পাঠকের কাছে। মোশাররফ খান একজন বহুদর্শী ও বহুমুখী কবি। তাঁর বহুদর্শিতার প্রাঞ্জলতা দেখি কাব্যের ছত্রে ছত্রে।
কবি প্রকৃতির কোলে হেসে খেলে বেড়ান। তাই প্রকৃতিই কবিকে বেশি ভাবায়। প্রকৃতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে কবির কাব্যসম্ভার। বৃষ্টি, খরা, শীত, হেমন্ত, শরৎ কিংবা বসন্ত কবিকে দারুণ আলোড়িত করেছে। বিশেষ আলোড়িত করেছে হেমন্ত। হলুদাভ ফুলের আর কচি পাতার খানিক শীতের হেমন্ত ভিন্নমাত্রা পেয়েছে খানের কবিতা কাননে। ফুল, পাখি, লতাপাতা, ঘাস কিংবা নদী যেন হরিৎ কাব্যিক বাগান। প্রকৃতি মুখরতা তাকে করেছে রাজসিক।
তাঁর আলোচিত কিশোর উপন্যাস ‘সাগর ভাঙার দিন’ যেন পুনঃ পাঠ হয় ‘বৈশাখি তা-ব’ কবিতা পড়লে। কিশোর কবিতা আলাদা এক রূপ পরিগ্রহ করেছে কবির হাতে। তাঁর মাতৃভাষাপ্রীতি উল্লেখযোগ্য। ইতিবাচক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন কিশোরদের নিকট খানের কবিতা পরম আদরণীয়।
ইতিহাস সচেতন তিনি। ইতিহাসের নানা ঘটনা উদাহরণ বা উপমায় এনে কাব্যের শিল্পমান বাড়িয়েছেন। সাথে আমাদের সচেতন করেছেন। ভাষার ব্যবহার খুবই সচেতনভাবে করেছেন। শুধু একজায়গায় ‘শালা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইংরেজি ভাষার শব্দ তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আরবি ও ফারসি ভাষার অনেক শব্দই তিনি ব্যবহার করেছেন অনায়াসে। অনেক লোকজ শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। ‘বন্য বরাহ’, ‘উত্তাল তরঙ্গ’, ‘এশিয়া’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ বা শব্দের ব্যবহার প্রায়ই লক্ষিত হয়েছে।
কবিতাকে কবিতা হয়ে ওঠার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কবির সে বিষয়ে যদি দক্ষতার অভাব থাকে তাহলে সে কাব্যগ্রন্থ নামক পুস্তকের খাতায় লিপিবদ্ধ এলোমেলো কথাবার্তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কবি মুক্তি পান না অকবির খেতাব থেকে। কিন্তু খান একজন জাত কবি। কবিতা নেশা, ধ্যান-জ্ঞান। তাই কাব্যকলার সব বিষয় তাঁর আয়ত্তে। উল্লেখযোগ্য শ্রেণির পাঠকের তিনি প্রিয় কবি তাই বারংবার মুদ্রণ হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ।
কবিতার প্রধান উপকরণ দু’টি। যথা: অলংকার ও ছন্দ। মোশাররফ হোসেন খান এমনই ধীমান কবি যে, তাঁর কাব্যের প্রায় প্রত্যেক ছত্রেই এদুটো বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেখানে যেমন থাকে অলংকার, চিত্রকল্প বা ইমাজেরি, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ। তেমনই থাকে সর্বজন গ্রাহ্য, বহুলব্যবহৃত শব্দমালা। প্রমিত শব্দ, চিত্র, উপমা আর নব নব চিত্রকল্প তৈরি করেছেন তিনি। কাব্যের পঙক্তির পর পঙ্ক্তি পাঠে পাঠক পেরিয়ে যায় দৃশ্যের পর দৃশ্য। কাব্য বিষয় ও সুষমায় অনন্য তাঁর কবিতা। গীতিকবিতার যে মূল ঢঙ তা বজায় রেখে চলেছেন তিনি। টুকরো কবিতা, দীর্ঘ কবিতা, ছড়া, গদ্য কবিতা, সনেট ইত্যাদিতে সমান পারঙ্গমতা তাঁর।
বিশ্বমানবতার কবি মোশাররফ হোসেন খান যে কাব্য বলয় সৃষ্টি করেছেন তার মূল্যায়ন স্বল্প পরিসরে করা একটি বিরাট বটগাছকে হাতের থলেতে প্রবেশ করানোর মতো বেমানান। তাঁর কাব্যসম্ভার নিয়ে বৃহৎ গবেষণা হওয়া দরকার। তাহলেই তাঁকে সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভবপর।