গ. মুসলিম শাসকদের আমলে ব্যাংকিং
খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া খিলাফত আমলে ইসলামী ব্যাংকিং আরো প্রসার লাভ করে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময় ব্যাংকিং লেনদেন বৃদ্ধি পায়। চতুর্থ শতাব্দীতে আলেপ্পোর আমির সাঈফ-আদ-দৌলা হামদান-এর সময় হুন্ডির ভিত্তিতে ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। ১০১০ সালে বসরায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হুন্ডির লেনদেন এবং মুদ্রা বিনিময় ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এগারো শতকের মধ্যভাগে পারস্য পর্যটক নাসের খসরু বসরায় ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যাপক প্রচলনের কথা তাঁর সফরনামায় উল্লেখ করেছেন।
আব্বাসীয় খিলাফত আমলেও ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসার জোরদার হয়। তখনকার বিশিষ্ট দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তাবিদরা অর্থনৈতিক লেনদেন এবং ব্যাংকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইমাম আবু ইউসুফ (৭৩১-৭৯৮), আল-শায়বানি (৭৫০-৮১৮), আল-মুহাসিবী (৭৮১-৮৫৭), আল-মাওয়ার্দী (৯৭৪-১০৫৮), আল-ফারাবি (৯৫০), ইমাম গাজালি (১০৫৫-১১১১), নাসির উদ্দিন তুসি (১২০১-১২৭৪), ইবনে তাইমিয়া (১২৬২-১৩২৮), আল-শাতিবী (মৃত্যু ১৩৮৮), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) প্রমুখ। পরবর্তীকালে অষ্টাদশ শতকের পর শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬৩) ইসলামী চিন্তা, দর্শন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। তারা সরকারি ব্যয়, বিনিময় বাণিজ্য, কর, শ্রম বিভাজন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি অর্থনৈতিক বিষয়ে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন।
ঘ. রাজনৈতিক চেতনা ও অর্থনৈতিক ভাবনা
এভাবে ক্রমান্বয়ে ইসলামী ব্যাংকিং মুসলিম দেশগুলোতে প্রসার লাভ করে। এরপর একসময় উসমানি সালতানাতের পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদতলে পিষ্ট হয়। ফলে মুসলিম দেশগুলো হারায় তাদের স্বকীয় মর্যাদা। এই পরাধীনতার জাল ছিন্ন করতে মুসলমানদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এ সময় তারা আবার ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জেগে ওঠে এবং বিংশ শতকের শুরুতে মুসলিম সমাজ পুনর্গঠনের কাজ জোরেশোরে শুরু হয়। এই শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে মুসলমানদের চিন্তার জগতে ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ গঠনের চেতনা বলিষ্ঠতা লাভ করে। এ সময় মুসলমানদের চিন্তার জগতে বিস্ফোরণ তৈরি করেন বেশ ক’জন চিন্তাবিদ ও বিশ্ববরেণ্য মনীষী। এরা হলেন ড. মুহাম্মাদ ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮), মিসরের হাসান আল-বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) এবং মওলানা আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯), সাইয়েদ কুতুব শহীদ (১৯০৬-১৯৬৬)। তাদের হাত ধরে পঞ্চাশের দশকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক কাঠামোতে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে চিন্তা, গবেষণা এবং বাস্তব প্রয়োগের কার্যক্রম জোরদার হয়।
ঙ. ইসলামী ব্যাংকের কাঠামোগত প্রস্তুতি
বিশ শতকের ইসলামী চিন্তাবিদদের উৎসাহ, প্রেরণা ও দিকনির্দেশনার আলোকে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবতার জগতে প্রবেশ করে। এ সময় ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা হিফজুর রহমান ও সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী তাদের প্রকাশিত (সুদ) গ্রন্থে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী ইসলামী ব্যাংকিংয়ের একটি কাঠামোগত রূপরেখা পেশ করেন। ১৯৫২ সালে শেখ মাহমুদ আহমদ তার ‘Economics of Islam’ প্রবন্ধে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয় উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালে মোহাম্মাদ উজায়ের তার ‘An outline of interestless Banking’ শীর্ষক প্রবন্ধে ইসলামী ব্যাংকের কর্মপদ্ধতিতে মুদারাবা মূলনীতি সংযুক্ত করার কথা বলেন। এদিকে মোহাম্মাদ আল-আরাবি (১৯৬৬) এবং এস এ ইরশাদ (১৯৬৪) চিন্তাবিদরাও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকৌশল হিসেবে মুদারাবা নীতি অনুসরণের পরামর্শ প্রদান করেন। ১৯৬৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থবিভাগের অধ্যাপক ড. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকংয়ের দ্বি-স্তর বিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন। পরবর্তী সময় তিনি মুশারাকা নীতি অন্তর্ভুক্ত করে ফান্ড ব্যবস্থাপনার দ্বি-স্তরবিশিষ্ট মডেল অধিকতর সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন। ১৯৮২ সালে এম. মোহসিন আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে একটি বিস্তৃত কাঠামোগত ধারণা উপস্থাপন করেন। (চলবে)