বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ন

শেখ হাসিনা কী নির্বাচনে অযোগ্য হচ্ছেন?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

গণহত্যার মধ্য দিয়ে ‘হাসিনা রেজিম’ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। দেড় দশকের সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যার অপরাধে তার বিরুদ্ধে এখন মামলা হচ্ছে। গণহত্যার তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার প্রতিটি ঘটনায় আসামি করা হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। পিলখানা হত্যাকা-ের নেপথ্য উদঘাটনে কমিশন গঠিত হয়েছে। অনুসন্ধান শুরু হয়েছে হাসিনার বেশ কিছু দুর্নীতিরও। হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম প্রচার করছে ‘হাসিনা বিরোধী’ নানা সংবাদ। এসব আয়োজন থেকে এমনটি প্রতীয়মান হতে পারে যে, এবার বুঝি শেখ হাসিনার রক্ষা নেই। সহসাই হয়তো তিনি সর্বোচ্চ দ-ে (মৃত্যুদ-) দ-িত হতে চলেছেন। রাজনীতির মাঠে হাসিনা এখন ঘৃণিত, অস্পৃশ্য,অপ্রাসঙ্গিক। প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে তার প্রত্যাবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণানিঃসৃত এ অনুধাবন আপাতঃ যথার্থ। কিন্তু বাস্তবতা কী ?
বাস্তবতা হচ্ছে, বিপুল হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক ‘দুখ-পাখি’। কর্মী-ভক্ত-অনুরক্তদের দুর্দশার সাগরে নিপতিত করে পালিয়েছেন তিনি। আইনের হাতেও অধরা হাসিনা। অনুগত কর্মীদের যা-ই হোক না কেন, নিজের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রভুদেশ ভারতকে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো জটিল ও সময় সাপেক্ষ। আইনজ্ঞরা মনে করছেন, বিচার হয়তো হবে হাসিনার অনুপস্থিতিতেই। সেই বিচারও আরেক সময় সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু যেভাবে ‘নির্বাচন-নির্বাচন’ কোরাস ধ্বনি উঠেছে তাতে অনুমান করা যায়, নির্বাচনের টাইমলাইন ঘোষিত হবে শিগগির। ২০২৫-২০২৬ সালের মধ্যেই হয়তো বাজবে নির্বাচনের সানাই। কিন্তু এর মধ্যে কি হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং দোসরদের ‘দ-িত’ করা সম্ভব? সম্ভব না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাসিনা, পরিবারের সদস্য এবং দলীয় নেতাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ঠেকানোর আইনি পথ কি ? হাসিনার লুটপাট আর গণহত্যার দোসরদেরই বা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ঠেকানো যাবে কিভাবে?
সেব বাস্তবতা বেরিয়ে আসছে তা খুব সুখকর নয়। নির্বাচন করা মানুষের নাগরিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান। এ অধিকারবলে শেখ হাসিনা নির্বাচন করতে পারবেন। একই কারণে তার দোসরদেরও নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা নেই। যদি না তারা সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ (২)(ঘ) অনুসারে নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন ২ বছর দোষী সাব্যস্ত না হন। দোষী সাব্যস্ত হলেও মুক্তিলাভের ৫ বছর পর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু এমন একটি মামলাওকি এমন পর্যায়ে এসেছে,যা দিয়ে শেখ হাসিনার নির্বাচনে অংশগ্রহণ আইনিভাবে ঠেকানো সম্ভব?
গণহত্যার অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনাসহ ৪৬ জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন ১৭ অক্টোবর। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের হাজির করার নির্দেশ ছিলো। এর মধ্যে গ্রেফতারকৃত কিছু আসামিকে দুই দফায় হাজির করা হয়। হাসিনাকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারির নির্দেশ দেয়া হয় তখন। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ইউনিট রেড অ্যালার্ট জারি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালের আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অন্ততঃ এক মাস আগে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইন্টারপোলকে অনুরোধ জানাবে অ্যালার্ট জারির। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত হাসিনার বিরুদ্ধে অ্যালার্ট জারির কোনো তথ্য মেলেনি। যেটি হয়েছে, তা হচ্ছে হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। গত ২৩ ডিসেম্বর ভারত চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেছে। এ কাজটি হয়েছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। চিঠির কোনো জবাব মেলেনি। জবাব দেয়া-না দেয়া একান্তই ভারতের ইচ্ছাধীন। ফেরত চেয়ে চিঠি দেয়া এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা ভিন্ন জিনিস। চিঠির মাধ্যমে ভারত বার্তা পেয়েছে মাত্র। এটি এমন কোনো ওয়ারেন্ট নয় যে তামিল করতে হবে।
ফৌজদারি আইনে অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর মতে, হাসিনাকে ভারত ফেরত দেবে কি না-এটি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। ভারতের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ চাইলে ভারত ফেরত দিতে পারে। আবার নাও দিতে পারে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওয়ারেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের কি না সে প্রশ্ন তুলতে পারে ভারত। সেইদেশের নিজস্ব আইন রয়েছে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে নিয়মমাফিক অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট দিল্লিতে পৌঁছাতে হবে।
সিনিয়র এ আইনজীবীর আশঙ্কা, হাসিনাকে ফেরত দেয়ার প্রশ্নে ভারত কিছু চাতুর্যের আশ্রয় নিতে পারে। এই মর্মে একটি স্ট্যান্ড নিতে পারে যে, হাসিনাকে বাংলাদেশ নিজ ব্যবস্থাপনায় ভারত পাঠিয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় ভারত যাননি। ভারতও তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কিংবা উদ্ধার করে নিয়ে যায়নি। হাসিনা ভারতের ‘সম্মানিত অতিথি’। কোনো অতিথিকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই হাসিনার যতদিন ইচ্ছে ‘অতিথি’র মর্যাদায় ভারত রেখে দিতে পারে হাসিনাকে। অহেতুক বিতর্কের অবতারণা করতে পারে। এ ছাড়া এ বিষয়ে ইন্ডিয়া, শেখ হাসিনা কিংবা অন্যকোনো পক্ষ রোম স্ট্যাটিটিউ’র শরণাপন্ন হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে জটিলতা।
অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন এটিও মনে করেন, বিচার করার জন্য হাসিনার শারীরিক উপস্থিতি ট্রাইব্যুনালের জন্য জরুরি নয়। বিচার হতে পারে তার অনুপস্থিতিতেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। বিচার চলাকালে বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিপক্ষকে আপিল করার ‘অধিকার’ দেয়া হয়েছে এ সংশোধনীতে। যা শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত বিচারের ক্ষেত্রে আসামিপক্ষ পাননি। তখন পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আসামিপক্ষের আপিল করার বিধান ছিলো। পরবর্তীতে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার আপিল পর্যায়ে প্রসিকিউশনের পক্ষে আপিল করার বিধানও যুক্ত করে নেয় হাসিনা সরকার। অন্তর্র্বতীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান যুক্ত করায় এটির সুযোগ নেবে আসামিপক্ষ। এতে গণহত্যার বিচার বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তদুপরি হাসিনা এবং তার দোসরদের দ-িত করার বিষয়টি নির্ভর করে প্রসিকিউশন,ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি, সর্বোপরি ট্রাইব্যুনালের গতি ও দক্ষতার ওপর। সরকারের সদিচ্ছার ওপর।
এদিকে হাসিনা এবং তার মাফিয়াতন্ত্রের দোসরদের দুর্নীতি মামলায় দ-িত করা নিয়েও আইনজ্ঞদের রয়েছে সংশয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো: মঈদুল ইসলামের মতে, বিদ্যমান অবস্থায় দুর্নীতি মামলায় শেখ হাসিনা,তার পুত্র-কন্যা, বোন এবং অন্য দোসরদের দ-িত করা একেবারে অসম্ভব। যে গতিতে কাজ করলে আগামী নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ের ভেতর তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব সেই গতি দুদকের নেই। আদালতেরও নেই। আওয়ামী নেতা ড.মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ঘটনার দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বলেন, মামলা বিচারাধীন থাকলে নির্বাচন করতে কোনো অসুবিধা নেই। এমনকি দুর্নীতি মামলায় দ-িত হলেও যে নির্বাচন করা যাবে না-এমনটি নয়। ড. ম.খা.আলমগীর দুর্নীতি মামলায় দ-িত ছিলেন। তিনি নির্বাচন করেছেন। মন্ত্রিত্ব করেছেন। সেসব রায়- রেফারেন্সের সুযোগ অবশ্য দ-িতপক্ষগণ নেবেন। শেখ হাসিনা,তার পরিবারের সদস্য এবং ওই রেজিমের অন্য দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সবে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এগুলোর কবে অনুসন্ধান শেষ হবে, কবে মামলা হবে, কবে তদন্ত শেষ হবে, কবে বিচার হবে, কবে আপিল হবে? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে বিচারে কারাদ- প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা যাবে- এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি,অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টসহ আইনি নানা রকম প্যাঁচ খেলার বিষয়তো রয়েছে। এসবের বেনিফিট অভিযুক্তরা নেবেই।

যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান তদন্ত চলছে তাদের বিরুদ্ধে কবে রায় হবে। কবে আপিল হবে ? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের নির্বাচনে অযোগ্য করা যাবে এমন কোনো কারণ দেখছি না। কোর্ট-কাচারির অনেক রেফারেন্স আসবে। সেগুলোর বেনিফিট অভিযুক্তরা নেবে।
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতি আছে। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কনভিক্টেট করে অযোগ্য ঘোষণা করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সব কিছু দ্রুত হলেও হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে আইনি প্যাঁচ খেলবে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, গণহত্যার দু’টি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে তদন্ত সংস্থা। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ভারতের কাছে ফেরত চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী যে, সংস্থা যথা সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com