রিজিক আরবি শব্দ, এর অর্থ অনেক ব্যাপক। আল্লামা ইবনে ফারিস রহ. তার অভিধানে লিখেছেন, ‘রিজিক হলো সময় অনুযায়ী প্রদান করা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান।’ তবে রিজিক শব্দটি শুধু ‘দান’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। (মাকায়িসুল লোগাহ, পৃষ্ঠা-৩৩৩) বিখ্যাত আরবি অভিধানপ্রণেতা আল্লামা আবু নসর জাওহারি রহ. লিখেছেন, ‘যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হয়, তার সবই রিজিক।’ (আস সিহাহ, পৃষ্ঠা-৪৪০)
রিজিক মানে শুধু খাদ্যসামগ্রী নয়; বরং জীবনোপকরণের সব কিছু। আল্লাহ তায়ালা বান্দার তাকদিরে যা লিখে রেখেছেন এবং যতটুকু লিখে রেখেছেন, যেভাবে লিখে রেখেছেন, ততটুকু সে পাবেই এবং সেভাবেই পাবে। সে অক্ষম হোক বা সক্ষম। আল্লামা ইবনে মানযুর রহ. লিখেছেন, ‘রিজিক দুই প্রকার : ১. দেহের জন্য রিজিক, যা খাদ্য; ২. রূহের ও আত্মার জন্য রিজিক, আর তা হলো জ্ঞান।’ (লিসানুল আরব, ইবনে মানযুর, খ–৫, পৃষ্ঠা-২৩৯)
আল্লামা কুরতুবি রহ. বলেছেন, ‘রিজিকের আভিধানিক অর্থ এমন বস্তু যা কোনো প্রাণী আহার্যরূপে গ্রহণ করে, যার দ্বারা সে দৈহিক শক্তি সঞ্চয়, প্রবৃদ্ধি সাধন এবং জীবন রক্ষা করে থাকে। রিজিকের জন্য মালিকানা-স্বত্ব শর্ত নয়। সব জীব-জন্তু রিজিক ভোগ করে থাকে কিন্তু তারা তার মালিক হয় না। কারণ, মালিক হওয়ার যোগ্যতাই ওদের নেই। যেমন ছোট শিশুরাও রিজিক পায় কিন্তু সে তার মালিক নয়, অথচ ওদের রিজিক অব্যাহতভাবে তাদের কাছে পৌঁছতে থাকে।’ (কুরতুবি)
পবিত্র কুরআনে রিজিক শব্দটি বিভিন্নভাবে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিজিক কিভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে তা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘জমিনে বিচরণশীল এমন কোনো প্রাণী নেই যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই, তিনি জানেন কোথায় তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল, সব কিছুই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’ (সূরা হুদ, আয়াত-৬)
মহান আল্লাহ রিজিকদাতা, তাঁর আছে অফুরন্ত রিজিক- যা তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে বিতরণ করেন। তাঁর রিজিক প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- বান্দাহর প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দেয়া। এ অর্থেই আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন বা বিশ্বজগতের পালনকর্তা।
প্রতিটি প্রাণী জীবন ধারণের জন্য আল্লাহ তায়ালার এমন বিশেষ দানকে রিজিক বলা হয়, যা নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী দেয়া হয়, আর তার মাধ্যমে প্রাণীটির সার্বিক উপকার সাধিত হয়। অর্থাৎ রিজিক সেটিই, যা বান্দার উপকারে আসে। উপকারে আসার বিষয়টিও ব্যাপক- ইহকাল ও পরকাল, উভয়কালই তাতে অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম আমাদের জীবন সম্পর্কে যে ধারণা দেয়- যেহেতু সেই জীবনের শুরু হয়েছিল আলমে আরওয়াহতে (রূহের জগৎ), পরবর্তীতে আলমে আজসাম (দুনিয়ার জীবন), এরপর আলমে বারজাখ (অন্তর্র্বতীকালীন জগৎ), সর্বশেষ আলমে আখিরাত বা বিচার ফায়সালা পরবর্তী অনন্তকালের জগৎ, সুতরাং জীবনের ব্যাপক অর্থের দিকে খেয়াল রেখে কোনো ব্যক্তি বা প্রাণী যদি ইহকালে যথাযথভাবে রিজিকপ্রাপ্ত না হয়, পরকালে সে অবশ্যই তা পাবে। বস্তুত যা কিছু দেহ ও রূহের খোরাক মেটায়, তাই রিজিক। মোট কথা, আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ অনুগ্রহের নাম রিজিক, যা তিনি মানুষসহ সব প্রাণীকে নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী দিয়ে থাকেন। সেজন্যই রিজিক কেবল শারীরিক বিষয় নয়- মানসিক-আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- তৃপ্তি অনুভব করা, স্বস্তিতে থাকাও রিজিকের উদাহরণ।
রিজিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন তাকদিরের উপর ঈমান
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদিতায় স্বীকৃত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই আপন মাতৃগর্ভে ৪০ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ওই রকম ৪০ দিন রক্তপি-, তারপর ওই রকম ৪৩০ দিন মাংসপি-াকারে থাকে। এরপর আল্লাহ তায়ালা একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিজিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য-এ চারটি বিষয় লিখার জন্য আদেশ দেন। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে যে কেউ অথবা বলেছেন, কোনো ব্যক্তি জাহান্নামিদের আমল করতে থাকে। এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র একহাত বা এক গজের দূরত্ব থাকে এমন সময় তাকদির তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর তখন সে জান্নাতিদের আমল করা শুরু করে দেয়। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি জান্নাতিদের আমল করতে থাকে। এমন কি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত বা দুই হাত দূরত্ব থাকে এমন সময় তাকদির তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর ওমনি সে জাহান্নামিদের আমল শুরু করে দেয়। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।’ (বুখারি-৬৫৯৪)
রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেছেন-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যিনি রিজিকদাতা, শক্তির আধার ও পরাক্রমশালী।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত-৫৮) ‘জমিনে বিচরণশীল এমন কোনো প্রাণীও নেই যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই, তিনি জানেন কোথায় তাদের আবাসস্থল ও কোথায় সমাধিস্থল, সব কিছুই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’ (সূরা হুদ, আয়াত-৬) ‘জনপদগুলোর লোকেরা যদি ঈমান আনত আর তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান আর জমিনের কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম কিন্তু তারা (সত্যকে) প্রত্যাখ্যান করল। কাজেই তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৯৬)
উল্লিøখিত আয়াতগুলোতে এ কথা স্পষ্ট, রিজিকদাতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা নেই। মানুষসহ সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব একমাত্র তাঁর জিম্মায়।
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রাখতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিজিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরও রিজিক দেয়া হতো। পাখিরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি-২৩৪৪, ইবন মাজাহ-৪১৬৪)
অনুসন্ধান করার শর্তে রিজিক নির্ধারিত : প্রত্যেক মানুষের রিজিক নির্ধারিত। একজন মানুষ যা কিছু প্রাপ্ত হন বা লাভ করেন, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল বলে তিনি তা পেয়ে থাকেন। যা কিছু মানুষ প্রাপ্ত হন না বা লাভ করেন না, তা নির্ধারিত ছিল না বলেই তিনি তা পাননি বা লাভ করেননি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-‘আমি অবশ্যই জমিনে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছি, আর তাতে রেখেছি তোমাদের জন্য জীবনোপকরণ। (অথচ) তোমরা অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-১০)
রিজিক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হলেও তা অনুসন্ধান করা বান্দার কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন বলেই বিষয়টি এমন নয় যে, সেই রিজিক আপনা-আপনি আমাদের কাছে এসে হাজির হবে।
বস্তুত আল্লাহ তায়ালা মানুষকে হালাল উপায়ে রিজিক অন্বেষণের নির্দেশ দিয়েছেন। ‘এরপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমুয়াহ, আয়াত-১০)
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘…যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য উত্তীর্ণের পথ বের করে দেবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত অবস্থান থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। (তবে) নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ (সূরা তালাক, আয়াত : ২-৩)
হজরত মুত্তালিব ইবনে হানতাব রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই জিবরাইল আমার অন্তরে ওহি ঢেলে দিয়েছেন যে, অবশ্যই রিজিক শেষ হওয়ার আগে কারো মৃত্যু হয় না। সুতরাং তোমরা হারাম ছেড়ে হালাল পথে রিজিকের অনুসন্ধান করো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, খ–৯, পৃষ্ঠা-২৫৪)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা দ্বীনের ফরজগুলোর মধ্যে অন্যতম।’ (সুনানুল কুবরা-বায়হাকি, খ–৬, হাদিস-১১৬৯৫)
হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো। কেননা, কোনো ব্যক্তিই তার জন্য নির্ধারিত রিজিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না, যদিও তার রিজিকপ্রাপ্তিতে কিছু বিলম্ব হয়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো, যা হালাল তাই গ্রহণ করো, যা হারাম তা বর্জন করো।’ (ইবনে মাজাহ-২১৪৪)
ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, ‘যা কিছু তোমার জন্য লিখিত সেটি পাহাড়ের চূড়ায় থাকলেও তোমারই হবে। আর যা কিছু তোমার জন্য লেখা হয়নি, সেটি দুই ঠোঁটের মধ্যখানে থাকলেও তোমার হবে না।’
তাই আপনার জন্য নির্ধারিত রিজিক আপনার কাছে সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, সঠিক উৎস থেকে পৌঁছে যাবে আল্লাহর হুকুমে। তবে এ জন্য যে কাজটি করতে হবে, তা হলো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে হালাল পথে যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। বাকিটা আল্লাহর জিম্মায়।
যেসব কাজে মানুষের রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়
১. পাপকাজে লিপ্ত হওয়া : হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সৎকর্ম মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে এবং দোয়া মানুষের তাকদির রদ (পরিবর্তন) করতে পারে। আর মানুষ তার পাপ কাজের কারণে প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইবনে মাজাহ-৪০২২)
২. অকৃতজ্ঞ হওয়া : আল্লাহ-তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে মনে রেখো আমার শাস্তি বড়ই কঠোর।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৭)
৩. মিথ্যা কসম খাওয়া ও ধোঁকা দেয়া : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বেচাকেনা করার সময় তোমরা অধিক কসম করা থেকে সাবধান থেকো। কারণ, মিথ্যা কসমের দ্বারা বিক্রি বেশি হয় কিন্তু বরকত ধ্বংস হয়ে যায়।’ (মুসলিম-১৬০৭) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা যতক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা কিংবা বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। যদি তারা সত্য বলে এবং পণ্যের প্রকৃত অবস্থা ব্যক্ত করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং পণ্যের দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (বুখারি-২০৭৯) ( অসমাপ্ত)