নতুন শিক্ষাবর্ষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের হাতে এখন পর্যন্ত একটি বইও পৌছাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে পাঠদান কার্যক্রম। উপজেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বই না থাকার অজুহাতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছেন না ক্লাসে। শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় ক্লাস করাতে শিক্ষকদের মাঝে অনাগ্রহ দেখা গেছে। বই সংকট শুধু শিক্ষার গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে না বরং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে একাধিক অভিভাবকরা জানিয়েছেন। বিভিন্ন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বই না পাওয়ায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাদরাসামুখী হচ্ছেন না। অধিকাং মাদরাসায় একটি বা দু’টি করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। সেখানেও তেমন উপস্থিতি নেই। বই না থাকায় ক্লাসে মনোযোগী হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরোনো বই দিয়ে দু-একটি ক্লাস টেনেটুনে করানো হচ্ছে। তবে ক্লাসে উপস্থিতি একেবারে কম। যারা আসে তারাও মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতে চায় না। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক, নি¤œ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও সব বই শতভাগ আসেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলার সরকারি প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব বই দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানরা জানিয়েছেন তারা চাহিদা অনুযায়ী বই পাননি। এছাড়া নি¤œ মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালগুলোতে এখন পর্যন্ত সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌছায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সব বই এখন পর্যন্ত তারা শতভাগ পাননি। তবে প্রাথমিকের পঞ্চম শেণি ছাড়া সব ক্লাসেই আংশিক বই পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। শ্রীমঙ্গল পৌর এলাকার কালিঘাট রোডে অবস্থিত হাজী সোনা মিয়া সুরজান বিবি আলিয়া মাদরাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদা রহমান সুমাইয়া, দ্বিতীয় শ্রেণির আহমদ মুসা, তৃতীয় শ্রেণির আয়শা আক্তার বলেন, ফেব্রুয়ারি চলে আসছে আমরা এখনও নতুন কোনো বই পাইনি। পুরনো বই থেকে আমাদের মাদরাসার শিক্ষকরা ক্লাস করাচ্ছেন। নতুন বই পেলে ক্লাস করতে ভালো লাগবে। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের নোয়াগাঁ গ্রামের মোস্তাইজ বিল্লাহ সুন্নিয়া ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার মীম, দ্বিতীয় শ্রেণির এনামুল হক মাহি, তৃতীয় শ্রেণির তানভীর এবং চতুর্থ শ্রেণির রাহিমা আক্তার জানায়, তাদের মাদরাসায় একজন শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত একটি বইও পায়নি। মাদরাসার শিক্ষকরা তাদের গত বছরের পুরোনো বই দিয়ে দই-তিনটি ক্লাস করাচ্ছেন। নতুন বই না পাওয়ায় ক্লাস করতে বা মাদরাসায় আসতে তাদের অনাগ্রহের কথাও জানায় শিক্ষার্থীরা। শহরের কলেজ রোডের গাউছিয়া শফিকিয়া সুন্নিয়া দাখিল মারাসার ইবতেদায়ির শিক্ষার্থী তামান্না, আরিফ হাসান, জামিনা, শহিদুল বলে, আমরা এখন পর্যন্ত নতুন বছরে একটি বইও পাইনি। তবে পুরান বই থেকে মাঝেমধ্যে আমাদের দুই-তিন বিষয়ের ক্লাস হয়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরাও কম আসে। আর ক্লাস করতে আমাদেরও ভালো লাগে না। আব্দুল মোহাইমিন ও হাবিবুর রহমান নামের দু’জন অভিভাবক হতাশা জানিয়ে বলেন, বছরের প্রথম মাস শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহ চলে এলো, অথচ আমাদের সন্তানেরা এখনও বই পেল না। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যেমন কমে যাবে, তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে যাবে। এবিষয়ে গাউছিয়া শফিকিয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা সাইফুর রহমান বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখন আমরা ইবতেদায়ির কোনো বই পাইনি। নতুন বই না আসলে ক্লাসও ঠিকমতো করানো যাচ্ছে না। বইয়ের অজুহাতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত মাদরাসায় আসতে চাচ্ছে না। বই না পাওয়া পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে পাঠদান করানো সম্ভব হবে না। মোস্তাইজ বিল্লাহ সুন্নিয়া ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা হোসাইন আহমদ বলেন, ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহ চলে আসলো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ইবতেদায়ির কোনো ক্লাসেরই একটি বই পাইনি আমরা। বারবার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করলেও কবে আসবো এটাও জানতে পারিনি। বই না পাওয়ায় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো উপস্থিত হচ্ছে না। এতে পাঠদানে ব্যঘাত ঘটছে। শিক্ষার্থীদের হাতে শতভাগ বই তুলে দিতে না পারার কথা স্বীকার করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বর্ধন। তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২৫টি ইবতেদায়ি মাদরাসা ও ৪৫টি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক ও দাখিল মাদরাসার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির অধিকাংশ বই বিতরণ করা হয়েছে। আমরা ইবতেদায়ি মাদরাসার জন্য মোট ৪০ হাজার ৮৭০ কপি চাহিদা দিয়েছিলাম। কিন্তু খন পর্যন্ত ইবতেদায়ির কোনো শ্রেণির একটি বইও আসেনি। ইবতেদায়ির কোনো ক্লাসের বই না আসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি বইও পৌছানো সম্ভব হয়নি। শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সব বই ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। তবে চতুর্থ শ্রেণির দুটি বই এসছে এবং প্রঞ্চম শ্রেণির কোনো বই আসেনি। উপজেলায় চাহিদা অনুযায়ী বই না আসায় সব প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বই দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পর্যায়ক্রমে তাদের চাহিদা পূরণ করা হবে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ ইসলাম উদ্দিন বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় শুধু ইবতেদায়ি ছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে বই পৌছানো হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণও করা হয়েছে। তবে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এ বছরের পরিস্থিতি ভিন্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ও পাঠ্যবই ছাপানোর রি-টেন্ডারসহ বেশকিছু পরিবর্তন আসে। এরপর পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই পরিমার্জনে অনেক সময় ব্যয় হয়। বই নির্ভুল করতে সম্পাদনায়ও যায় অনেকটা সময়। এসব কারণে বই ছাপানোর কাজ শুরু করতেই দেরি হয়ে যায় এবার। যার কারণে বছরের শুরুতেই সব প্রতিষ্ঠানে সব বই পৌছানো সম্ভব হয়নি। দ্রুত গতিতে বই ছাপ ও সরবরাহ করার কাজ চলছে। সরকার এক্ষেত্রে খুব আন্তরিক। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অবশিষ্ট বইগুলো পেয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা।