যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ। শ্রদ্ধাসহগত চিত্তে দিনটি পালন উপলক্ষে বনফুল গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে ছিলো-ভাষাবীরদের স্মরণে কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাত ফেরি, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা প্রদর্শণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার বিতরণী।
এ উপলক্ষে দিনের প্রথম প্রভাতে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় দীর্ঘ প্রভাত ফেরি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ অমর গানের সুর ছড়ানো প্রভাত ফেরিটি কলেজ সংলগ্ন প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়। এসময় বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সাথে কলেজ মাঠের শহীদ মিনারের বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সভাপতি ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো, রেক্টর প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়ুয়া এবং অধ্যক্ষ সুদীপ কুমার মন্ডল। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে শোক ও বেদনার দিনটিকে উপজীব্য করে আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোচনা সভার। অমর একুশের রক্তাক্ত ইতিহাস ও মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা সভায় কথা বলেন গভর্নিং বডির সভাপতি ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো, রেক্টর প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়ুয়া, অধ্যক্ষ সুদীপ কুমার মন্ডল এবং গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি ও সহাকারী অধ্যাপক মো. জাকিদুল ইসলাম। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক প্রতিনিধি মোস্তাকিয়া মাহমুদা পারভীন, অভিভাবক প্রতিনিধি ড. অমর কান্তি চাকমা, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ নাসির আফজাল এবং বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের সদস্য মি. সাধনা কীর্তি চাকমা প্রমুখ।
আলোচনা সভায় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কলেজের রেক্টর প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়ুয়া বলেন, একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার আদায়ের প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে উর্দু, ইংরেজি ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তরুণ কান্তি বড়ুয়া আরও বলেন, বহু আগ থেকেই আমাদের ছাত্রসমাজ ছিলো প্রতিবাদী। যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে তারা ছিলেন স্বোচ্চার। ১৯৫২ এর শহীদদের আত্মত্যাগ, ৫৮ এর সামরিক শাসন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈ^রাচার বিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন আমাদের ছাত্রসমাজ। তিনি বলেন, আমাদের সজাগ থাকতে হবে যাতে ছাত্রদের রক্তেভেজা অর্জন কোনভাবেই হারিয়ে না যায়। এসময় প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়ুয়া স্বরচিত কবিতা পাঠ করে মুগ্ধ করেন উপস্থিত সকলকে।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বলেন, সকলকে ঐক্য, সমঝোতা ও বৈষম্যহীন চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সাত্যিকার সঠিক জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে আদর্শবান নাগরিক হয়ে মাতৃভূমির সেবায় নিবেদিত থাকতে হবে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা নিজেরাই নিজেদের ত্রাণকর্তা। মহৎ ও সৎ কর্মে নিবেদিত থাকতে হলে নিজেদেরকে নিজেদের ত্রাণকর্তা ভেবে সত্য এবং মঙ্গলের পথে চলতে হবে, সাধ্য মতো অবদান রাখতে হবে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সমৃদ্ধিতে। ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর কথায় একটি তথ্য উঠে আসে যে, দেশে ৪০টির মতো আদিবাসী ভাষা থাকলেও এর মধ্যে প্রায় ১৪টির মতো ভাষা বিলুপ্তির পথে। তিনি ভাষাগুলো রক্ষার ব্যাপারে সরকার ও সকলের সহযোগিতা কামনা করেন এবং আশু পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানান।
দিবসটিকে আরও তাৎপর্যময় করতে ছাত্রছাত্রীরা সুনিপুণ হাতের লেখায় তৈরি করেছেন দেয়ালিকা। অধ্যক্ষ, রেক্টর এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে নিয়ে মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রতিলিপি দেয়ালিকার উদ্বোধন করেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সভাপতি ভেন. প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো। জাতীয় দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক স্মৃতিময়ী বসাক ও কমিটির সদস্যদের পরিচালনায় অমর একুশের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিকা তাহমিনা এবং সহকারী শিক্ষিকা রানজুনি চাকমা। দিবসটি পালনের শেষাংশে ছিলো সাংস্কৃতিক ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে স্বরচিত কবিতা পাঠ, সমবেত কন্ঠে খ্যাতিমান কবিদের কবিতা থেকে আবৃত্তি এবং সংগীত পরিবেশনা সকলকে মুগ্ধ করে। আনন্দমুখর পুরস্কার বিতরণী পর্বে অমর একুশে উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন ইভেন্টে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন কলেজের রেক্টর প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়ুয়া, অধ্যক্ষ সুদীপ কুমার মন্ডল, গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি ও সহাকারী অধ্যাপক মো. জাকিদুল ইসলাম, অভিভাবক প্রতিনিধি ড. অমর কান্তি চাকমা, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ নাসির আফজাল এবং অন্যান্য অতিথিরা।