মেঘ-পাহাড়ের উপত্যকা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র ‘সাজেক ভ্যালি। দেশের পর্যটনশিল্পে সাজেক উপত্যকা পর্যটক ও বিনোদনপ্রেমী মানুষের কাছে পছন্দের শীর্ষে। গত সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারী) দুপুরের হঠাৎ এক আগুনে ‘অগ্নি পুরীতে পতিত হয়েছে সাজেক ভ্যালি। আগুনের ঘটনায় ৯৮টি স্থাপনা পুড়ে গেছে। এরমধ্যে লুসাই ত্রিপুরাদের ৩৬টি বসতঘর রয়েছে। পাহাড়ের চুড়ায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠার ফলে সাজেক ভ্যালিতে সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকট সঙ্গত কারণ রয়েছে। তবে ক্রমাগত এত বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও ছিল না যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দিয়েও ঝুঁকি মোকাবিলায় কটেজ-রিসোর্ট মালিকদের কাছ থেকেও সাড়া পাওয়া যায়নি বলছে রাঙ্গামাটির ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়। রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয় বলছে, কয়েক দফায় সাজেক কটেজ মালিক সমিতির নেতাদের সাজেক ভ্যালি উপত্যকা পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা (রিজার্ভার) রাখা, লাইসেন্স নেয়া, অগ্নি নির্বাপক স্প্রে ও কটেজ-রিসোর্টের জনবলকে যথাযথ ট্রেনিং দেওয়ার বিষয়ে বলা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি মালিকদের পক্ষ থেকে।
এছাড়া যত্রতত্র স্থানে রিসোর্ট-কটেজ নির্মাণ, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ও খালী স্থান না রাখার ফলেও ঝুঁকি বেড়েছে সাজেক ভ্যালিতে। হঠাৎ এক অগ্নি ট্র্যাজেডি পুড়ালো সাজেক ভ্যালির অন্তত ৯৫টির মতো স্থাপনা। শুধু রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ভ্যালি উপত্যকাই নয়, পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথাযথ অব্যবস্থাপনা রয়েছে তিন পার্বত্য জেলাজুড়েই। এ নিয়ে নীতিমালা কিংবা গাইডলাইন তৈরি প্রয়োজন মনে করছেন স্থানীয় খাতসংশ্লিষ্ট ও পর্যটন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকা এলাকাগুলোতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রিসোর্ট এর কটেজ নির্মাণ ও রিসোর্ট স্থাপন সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকা। ফলে যে যার ইচ্ছেমতো কটেজ নির্মাণ করছে ও ঘন ঘন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো শহর থেকে দূরে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোতে ফায়ার সার্ভিস ইউনিট না থাকা। সেই সঙ্গে সেসকল রিসোর্ট বা কটেজসমূহে নিজস্ব প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপন আয়োজন না থাকা। যেমন- ছোট কুপ খনন করে পানির রিজার্ভার রাখা, ফায়ার স্টিংগুইসার রাখা, বালি মজুদ রাখা ইত্যাদি। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পাহাড়ের প্রাকৃতিক ও প্রতিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনা না করে রিসোর্ট ও কটেজ স্থাপন করা। পাহাড়ের অতিসম্ভাবনাময়ী পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করার জন্য এসকল বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন স্থানীয় সংশ্লিষ্টরা। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের স্নাতক (সম্মান) ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারী) সাজেক ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে গিয়েছেন বিভাগটির চেয়ারম্যান মোসা. হাবিবা ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক খোকনেশ্বর ত্রিপুরা। খোকনেশ^র ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারী) সকালেও কয়েকজন মিলে ভাবছিলাম যেভাবে সাজেকে গণহারে রিসোর্ট-কটেজ হচ্ছে, এতে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে। এরমধ্যে দুপুরে এই ঘটনা ঘটলো। আমরা এখানে এসে অনুধাবন করেছি এত গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রে ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়, হাসপাতালসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই ব্যবস্থাপনা এখানে নেই। এখানে পানির জন্যই অনেক দূর থেকে সুপেয় পানি আনতে হয়, সেখানে ব্যবহার উপযোগী পানির সংকট তো আছেই। সে হিসাবে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখাও প্রয়োজন। আমি মনে করি কেবল সাজেক ভ্যালির ক্ষেত্রেই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রেও কটেজ-রিসোর্টের বিষয়ে অন্তত মিনিমাম গাইডলাইন থাকা উচিত। শুধু কমার্শিয়াল বিষয়গুলোকে দেখলেই হবে না। ঝুঁকি, নিরাপত্তার বিষয়গুলোও ভাবতে হবে।’ রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের সদ্য সাবেক সহকারী পরিচালক মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাঙ্গামাটি জেলায় দায়িত্ব পালন করেছি। সাজেক ভ্যালির কটেজ-রিসোর্ট সমিতির নেতাদের আমি বারবার বলেছি, আপনারা সাজেকে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থায় উদ্যোগ নেন। তিনটা বিষয়ে আমরা তাদের বলেছি, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা, লাইসেন্স নেওয়া ও জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা সব ধরণের সহায়তার কথা জানালেও তারা উদ্যোগী হননি। যদি তারা বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতেন সেক্ষত্রে আজকের এই ঘটনার হয়তো এত বড় হতো না। এখান থেকে তাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। একই সঙ্গে সকলকে অগ্নি ঝুঁকি মোকাবিলা করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন বলছেন তিনি। রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন ২০১৪ এর ২ এর ১৩ ধারা অনুযায়ী কটেজ-রিসোর্ট মালিকদেরও এই আইন অনুযায়ী লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে সাজেক ভ্যালির কটেজ রিসোর্টগুলোর মধ্যে কয়টি প্রতিষ্ঠান আইন মেনে লাইসেন্স নিয়েছেন আবার কয়টি আইন মানেননি আমরা অবশ্যই সেটি যাচাই করে দেখার পর জানতে পারব। যারা আইন মেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালন করেননি তাদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমরা প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।