ইসলামী ইতিহাসে হারুত ও মারুত এমনই এক জোড়া রহস্যময় নাম যাদের ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, উপকথা, এমনকি পৌরাণিক বর্ণনা পর্যন্ত—যা অনেক সময় মূল সত্যকে আড়াল করে দেয়।
এই প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করব কোরআন ও হাদিসের আলোকে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় ও শিক্ষা অনুসন্ধান করতে, যেখানে মানবকল্পনা নয়—বরং আল্লাহর বাণীই হবে প্রধান দিশারি।
ফোরাত নদীর তীরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া তৎকালীন সময়ের উন্নত এক শহরের নাম বাবেল। যার অবস্থান প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) মধ্যে।
বর্তমান দুনিয়া যেটিকে ব্যাবিলন (Babylon) নামে চেনে।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমি ব্যাবিলনের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রাচীন স্থাপত্য-এর কোনো কিছু নিয়েই আলোচনা করতে চাই না। এমনকি তামাম দুনিয়ার মানুষের ব্যাবিলন-বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু ঝুলন্ত উদ্যান নিয়েও কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি আজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই ব্যাবিলনের নাম মুখে নিলেই কল্পজগতে ভেসে ওঠা হারুত আর মারুতের কথা।
জাদুবিদ্যার জয়জয়কারের কথা। তবে জাদু বলতে ডেভিড কপারফিল্ডের চোখ-ধাঁধানো স্টেজ শো কিংবা ক্রিস অ্যাঞ্জেলের ভ্রু কোঁচকানো হাতসাফাইয়ের কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি এমন জাদুর কথা, যার বাস্তবতা বিজ্ঞান মেনে নিতে নারাজ। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের কোনো কিছু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার অতীত।
পবিত্র কোরআনের ভাষ্যমতে, “তারা ওই শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সোলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সোলাইমান কুফরি করেননি; শয়তানরাই কুফরি করেছিল। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই এ কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে ‘আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।’ অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে।
তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তা দ্বারা কারো অনিষ্ট করতে পারত না…” (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ১০২)
আলোচ্য আয়াতে হারুত ও মারুত বলে দুটি নাম রয়েছে। যাদের নিয়ে রচিত হয়েছে নানা কল্পকাহিনি। গদ্য-পদ্য আর সাহিত্যরসে ভরপুর সেসব ঘটনাবলি কমবেশি সবাই জানেন। অনেক মুফাসসিরের প্রদত্ত ব্যাখ্যায় দেখা যায়, তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতেন। তবে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে এটাও বলে দিতেন যে ‘আমরা পরীক্ষার জন্য, কাজেই তুমি কাফের হয়ো না।’ কিন্তু লোকজন সেসব শিক্ষা করে অসৎ কাজে ব্যবহার করতে শুরু করল। তাই আয়াতের শেষে বলে দেওয়া হয়েছে যে যারা এই জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে, তাদের জন্য পরকালে কিছুই নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আয়াতে উল্লিখিত নবী সোলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে জাদুর কী সম্পর্ক? সেটি জানতে হলে আমাদের চোখ বোলাতে হবে ইসলামপূর্ব জাতিগুলোর ইতিহাসের পাতায়। বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন—বিশেষ এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোলাইমান (আ.)-কে জাদুর অপবাদ দেওয়া হয়। আর তাঁর রাজ সিংহাসনের নিচ থেকে অন্য লোকের লুকিয়ে রাখা কিছু জাদুর বই উদ্ধার করা হয়। অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে সেগুলো নবী ইদ্রিস (আ.)-এর সময়কালের প্রাচীন বাবেলের জাদুবিদ্যার বই।
কোরআনের আলোচ্য আয়াতে সেই ঘটনারই জবাবে বলা হয়েছে যে সোলাইমান (আ.) কুফরি কালাম, জাদুবিদ্যা বা কোনো ডার্ক আর্ট ব্যবহার করেননি। বরং এসব চর্চা করত ইবলিশ শয়তান। সোলাইমান (আ.) সেসব বই পুঁতে ফেলেন এবং তাদের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর অসাধু লোকেরা সেগুলো খুঁড়ে আনে এবং রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। যা আজ “সোলেমানি তাবিজ” নাম দিয়ে এক নবীর প্রতি অপবাদ রটিয়ে রমরমা ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে আছে।
ফিরে আসছি মূল আলোচনায়। হারুত ও মারুত আসলে কে? এ নিয়ে রয়েছে নানা গল্প। ইমাম তাবারি (রহ.) ও ইবন জারির (রহ.)-এর মতে, কোরআনের আয়াতে উল্লিখিত শব্দ “মালাকাইনে” (দুজন ফেরেশতা) ও “মালিকাইনে” (দুজন শাসক) — উভয় পাঠ রীতি প্রচলিত।
যদি “মালিকাইনে” অর্থে ধরা হয়, তাহলে হারুত-মারুত ফেরেশতা নন, বরং তৎকালীন সময়ের দুজন বাদশাহ, যারা অপরাধ করে আল্লাহর কাছে দুনিয়াতেই শাস্তির প্রার্থনা করেছিলেন।
আর যদি “মালাকাইনে” অর্থে নেয়া হয়, তবে তাঁরা ফেরেশতা—যাদের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে জাদুবিদ্যার বাস্তবতা ও পরীক্ষার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। এটি তাঁদের কোনো শাস্তি নয়, বরং মানবজাতির পরীক্ষার অংশ।
কারণ ফেরেশতারা কখনো আল্লাহর আদেশ অমান্য করেন না। কোরআনের ভাষায়,“তারা আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা আদেশপ্রাপ্ত, তা-ই সম্পাদন করে।” (সুরা আত-তাহরিম, আয়াত ৬)
অতএব, হারুত-মারুতকে ঘিরে প্রচলিত “জোহরা নামের নারী” সংক্রান্ত গল্পগুলো নিছক মনগড়া ও মিথ্যা। ইসলামের দৃষ্টিতে ফেরেশতারা পাপ থেকে মুক্ত, আর তাঁদের নামকে কল্পগল্পে ব্যবহার করা মিথ্যা ও অপবাদ।
চলুন আমরা সত্য ধারণা গ্রহণ করি, কোরআনের আলোকে আল্লাহর সৃষ্টি ও পরীক্ষার রহস্য বুঝে নিই—
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সত্য বোঝার তাওফিক দান করুন। — আমিন।