শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ অপরাহ্ন

যা কিছু প্রয়োজন, আল্লাহকেই বলুন

জাফর আহমাদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২১

‘আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত, এ কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে’ (সূরা বাকারা-১৮৬)।
প্রত্যেক মানুষ ইচ্ছা করলেই সবসময় তার কাছে আর্জি পেশ করতে পারে। এতে তিনি সব কিছু শুনেন। কারণ তিনি সামিউম বাছির বা শ্রবণকারী ও মহাদ্রষ্টা। এমন কি মনে মনে যা আবেদন করা হয় তাও তিনি শুনতে পান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন’ (সূরা ইমরান-১১৯)। শুধু শুনতে পান না বরং সে সম্পর্কে তিনি সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। আকাশম-লে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা আমাদের থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্নস্তরে পতিত কোনো জিনিস আমাদের কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। কিন্তু তাঁর কাছে তা রয়েছে উজ্জ্বল আলোর মতো। কাজেই আমরা এমন কোথাও এমন কোনো অবস্থায়ও এমন কোনো সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারি না যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়। তিনি শুধু তা জানেন তাই নয়, বরং যখন হিসাব-নিকাশের সময় আসবে তখন তিনি আমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন।
আল্লাহ তায়ালা বান্দার এত কাছাকাছি অবস্থান করেন যে, কোনো প্রকার মাধ্যম ও সুপারিশ ছাড়াই বান্দা সরাসরি সর্বত্র ও সবসময় তাঁর কাছে আবেদন ও নিবেদন পেশ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ওহাব বা প্রকৃত দাতা। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কিছু কিছু বিষয় মনকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। এর মধ্যে একটি হলোÑ কিছু কিছু মূর্খ মানুষ সেই প্রকৃত দাতা আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি মানুষের দরবারে সন্তান কামনা করে থাকে। খুব ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের আচরণ সুস্পষ্ট শিরকের অন্তর্ভুক্ত। সন্তান দেয়ার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। হজরত ইবরাহিম আ: শেষ বয়সে এসে আল্লাহর কাছে বলছেন, ‘আমি আমার রবের দিকে যাচ্ছি, তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। হে পরোয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্রসন্তান দিন।’ (এ দোয়ার জবাবে) আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম’ (সূরা সাফফাত : ১০০-১০১) । কাজেই আমাদের প্রত্যেককে অক্ষম ও বানোয়াট খোদার দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুুকে মরার অজ্ঞতা ও মূর্খতার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। একজন ব্যক্তি দুনিয়ায় জীবন যাপনের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বস্তুগত বা অবস্তুগত যত কিছুর অভাব বা প্রয়োজন হয়, সবগুলোরই প্রকৃত দাতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তায়ালাই রিজিকদাতা তার বাস্তব প্রমাণ আমরা দেখতে পাই যখন অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি শুরু হয়। মাঠের পর মাঠ বিরানভূমিতে পরিণত হয়, তখন কোনো সৃষ্টির পক্ষে তার মোকাবেলা করার ক্ষমতা হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই তো তোমাদের নিদর্শন দেখান এবং তোমাদের জন্য আসমান থেকে রিজিক নাজিল করেন (কিন্তু এসব নিদর্শন দেখে) শুধু তারাই শিক্ষা গ্রহণ করে যারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী (সুতরাং হে প্রত্যাবর্তনকারীরা) দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁকেই ডাকো, তোমাদের এ কাজ কাফেরদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন’ (সূরা মুমিন-১৩)। এখানে রিজিক নাজিল মানে বৃষ্টিপাত। কেননা, মানুষ এ পৃথিবীতে যত প্রকার রিজিক লাভ করে তা সবই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসংখ্য নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে এ একটি মাত্র নিদর্শনের কথা ধরে তুলে এ মর্মে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, তোমরা যদি শুধু এ একটি জিনিসের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করো তাহলে বুঝতে পারবে, রিজিকদাতা শুধু আল্লাহ তায়ালা, সেটিই বাস্তব ও সত্য। আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই জ্ঞাত। প্রতিটি প্রয়োজন, যা ব্যক্তির মনের গহিনে লুপ্ত আছে, যার বহিঃপ্রকাশ এখনো ঘটেনি, তাও আল্লাহ তায়ালা জানেন। কারণ তিনি মহাজ্ঞানী, অতিশয় জ্ঞাত। তিনি অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোনো কথা বলেন না, বরং তিনি প্রতিটি বস্তু সম্পর্কেই সরাসরি জ্ঞানের অধিকারী। তিনিই একমাত্র জানেন কোন জিনিসে মানুষের উন্নতি এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো নীতিমালা, আইনকানুন ও বিধিনিষেধ আবশ্যক। তাঁর প্রতিটি শিক্ষা সঠিক কৌশল ও জ্ঞানভিত্তিক যার মধ্যে ভুল-ভ্রান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। ‘অবশ্যই আল্লাহ অন্তরের গোপন কথাও জানেন’ (সূরা লুকমান-২৩)।
সুতরাং জ্ঞান ও বিজ্ঞতার দাবি হচ্ছে এই যে, যাকে বুদ্ধি-জ্ঞান দান করা হবে তাকে তার কাজের জন্য দায়ীও করা হবে। তার জ্ঞান ও বুদ্ধি কোন কাজে কিভাবে ব্যবহার করেছে তা মহাজ্ঞানীর নখদর্পণে আছে। মানুষ, জিন, ফেরেশতা বা অন্য কোনো সৃষ্টিই হোক না কেন সবার জ্ঞান অপূর্ণ ও সীমিত। বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা এবং এর অন্তর্নিহিত কার্যকারণ ও ফলাফল বোঝার মতো জ্ঞান কারো নেই। বিশ্ব-জাহানের সমগ্র সত্য ও রহস্য কারো দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। বিশ্ব-জাহানের প্রভু ও পরিচালক মহান আল্লাহই পুরোপুরি জ্ঞান রাখেন। সব ক্ষেত্রে জ্ঞানের মূল উৎস মহান আল্লাহর হিদায়াত ও পথনির্দেশনার ওপর আস্থা স্থাপন করা ছাড়া মানুষের জন্য দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। সুতরাং তাঁর কাছেই চাইতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা ওয়াসিউ বা মহাবিস্তারক। এটি আল্লাহ তায়ালার ছিফতি নাম, যা ব্যাপকতার অর্থে ব্যবহৃত হয়। মূলে ‘ওয়াসে’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআনে সাধারণত তিনটি জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এক, যেখানে কোনো একটি মানবগোষ্ঠীর সঙ্কীর্ণমনতা ও সঙ্কীর্ণ চিন্তার উল্লেখ করা হয় এবং আল্লাহ তাদের মতো সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী নন, এ কথা তাদের জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দুই, যেখানে কারো কৃপণতা, সঙ্কীর্ণমনতা এবং স্বল্প সাহস ও হিম্মতের কারণে তাকে তিরস্কার করে মহান আল্লাহ যে উদার হস্ত এবং তার মতো কৃপণ নন, এ কথা বোঝানোর প্রয়োজন হয়। তিন, যেখানে লোকেরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে আল্লাহর ওপরও এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে এ কথা জানানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ তায়ালা সব প্রকার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে, তিনি অসীম। তিনি হিসাব ছাড়াই রিজিক দান করেন। সুতরাং বেশি পাওয়ার জন্য অযথা সব আজেবাজে জায়গায় দৌড়াদৌড়ি বেহুদাই।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিপদেরও বন্ধু। কারণ তিনি ওয়াকিল বা মহাপ্রতিনিধি, তত্ত্ব¡াবধায়ক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যাদেরকে লোকেরা বললÑ ‘তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে ভয় করো।’ তা শুনে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছেÑ ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং তিনি সবচেয়ে ভালো তত্ত্বাবধায়ক’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৭৩)। এ তো আল্লাহ, তোমাদের রব! তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। সব কিছুর তিনিই স্রষ্টা। কাজেই তাঁর বন্দেগি করো। তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক’ (সূরা আনয়াম-১০২)। সুতরাং বিপদে-আপদে আল্লাহর ওপর ভরসা ও বিশ্বাস রাখা উচিত। যার যা প্রয়োজন, তা মহান দাতা, মহান প্রভু, মহান তত্ত্বাবধায়ক, মহান বন্ধু আল্লাহ তায়ালার কাছেই চাওয়া উচিত।
লেখক : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com