শীতকাল মানেই পিঠা-পুলি আর রসের হাঁড়ি। সকালে গরম গরম ভাপা পিঠা আর খেঁজুরের রস বাংলার চির চেনা ঐতিহ্য। ভোরবেলা ঘন কুয়াশা ডিঙিয়ে গাছ থেকে রসের হাঁড়ি কাঁদে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটে যেতো গাছিরা। আর ঘরে চালের গুড়োয় বানানো পিঠা খেতে রসের অপেক্ষায় থাকতো গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা। বছর কয়েক আগেও এই চিত্র চোখে পড়লেও এখন আর এ দৃশ্যের দেখা মেলে না। পৌষ পেরিয়ে মাঘের শুরু। শীতও জেঁকে বসেছে গ্রাম অঞ্চলে। আর এই সময়টা ভরপুর রসের। কিন্তুু শীত শেষের দিকে এগোলেও দেখা নেই রস বিক্রেতাদের। এখন আর ভোরবেলা কেউ রস! রস! বলে ডাক হাঁকে না। কিংবা রসের জন্য বাড়ির প্রবেশ মুখে কাউকে অপেক্ষমান থাকতেও দেখা যায় না। এ যেন বাংলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ারই ইঙ্গিত। উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায়ও এ বাস্তবের অমিল নেই। এ উপজেলায় এক সময় শতশত খেঁজুর গাছ দেখা গেলেও এখন আর তা খুঁজে পাওয়া ভার। অধিকাংশ গ্রামে আগের খেঁজুর গাছগুলো অদৃশ্য। বছর চারেক আগে গাঁয়ের যেসব সড়ক ছিলো খেঁজুর গাছে সাজানো সেসব রাস্তা এখন গাছহীন। বেড়িবাঁধে সারি সারি খেঁজুর গাছ বিলুপ্তির পথে। দুয়েকটি থাকলেও সেগুলো কাটা হয়নি। মাটির হাঁড়ি, এক জটলা রশি, একট টুকরো বাঁশ নিয়ে ছেঁড়া সেন্ডেল পরে এখন আর কেউ গাঁয়ের মেঠো পথে হেঁটে যায়না। কাঁদে রসের ভার নিয়েও আসেনা কেউই। সীতাকু-ের সৈয়দপুর, মুরাদপুর, বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে আগের তুলনায় গাছির সংখ্যা কমে এসেছে, সেই সাথে কমেছে খেঁজুর গাছও। রস নিয়ে গাছিদের মাঝে পূর্বের উৎসাহও লক্ষ্য করা যায়নি। কাউকে কাউকে রসের ফরমায়েশ দিতেও দেখা গেছে। তবে রসের পরিমাণ কম হওয়ায় রস কিনতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৈয়দপুর ইউনিয়নের শেখের হাটের গাছি আবুল হক বলেন, আগের মতো রস এখন আর নেই। গাছ কাটা, রসি কেনা, হাঁড়ি কেনাসহ যাবতীয় খরচ ওঠাতে হিমশিম খেতে হয়। সারারাতে এক গাছে এক হাঁড়ি রসও পাইনা। মুরাদপুর ইউনিয়নের কৃষক রহমত আলী বলেন, রস আগের চেয়ে কম। খরচ পোষিয়ে আনতে বেশি দামে বিক্রির আশায় আমরা রস শহরে নিয়ে যাই। আগে থেকেই শহরের বেপারীরা রস কিনে নিয়েছে। বাড়বকুণ্ড বেড়িবাঁধে রস কিনতে আসা খালেক সুমন বলেন, শহরের ব্যবসায়ীরা গাছিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে গ্রামের রস শহরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামের রস আমরাই স্বাধ নিতে পারছিনা যা অত্যন্ত দুঃখের। একই কথা বলেন, রস কিনতে আসা সীতাকুণ্ডে র বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বিএসসি । তিনি জানান, রসতো এখন সোনার হরিণ! আগের দিনে রস বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি আসতো। আর এখন তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের আর রস খাওয়া হয়না। সাংবাদিক স.ম হাসান খবরপত্রকে বলেন, খেঁজুর রস ছাড়া শীতকাল উপভোগ করাই হয়না। আমাদের চির চেনা এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ঐতিহ্য রক্ষার্থে বন বিভাগের উদ্যোগে শতশত খেঁজুর গাছ লাগানো যেতে পারে। গাছিদের প্রণোদনা দিয়ে এ কাজকে ধরে রাখতে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। নইলে আমরা হারাবো আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সেই সাথে হারাবো প্রকৃতির আর্শীবাদও। কবি বাসু দেব নাথ বলেন, উন্নয়নের আড়ালে আমাদের দেশে কতগুলো কালো ধোঁয়ার মেশিন বসানো হচ্ছে, যা প্রকৃতিকে ধরে রাখার অন্তরায়। আগেকার দিনে যেসব জমিতে সবুজ শাকসবজি চাষ হতো এখন সেখানে রাঘব বোয়ালদের থাবা পড়েছে। গড়ে ওঠেছে অপরিকল্পিত শিল্প। আর এতে বিলীন হচ্ছে সোনার বাংলার সবুজ চিত্র। বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক দেবাশীষ ভট্টাচার্য খবরপত্রকে বলেন, আগের দিনে শীত এলেই ঠাকুমা’র হাতের বানানো পিঠা-পুলি খেতাম। এখন তা আর হয়ে ওঠে না। তখনকার দিনে গ্রামে গ্রামে পিঠা উৎসব হতো, রসের সিন্নি রাঁধা হতো। আমরা অনেক মজা করতাম। সোনালী সেই দিন এখন আর নেই। এসময় প্রবীণ এই সাহিত্যিক বলেন, এখন আমরা অতি আধুনিক। আধুনিকতার বেড়াজালে মিশে আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারাতে বসেছি। আজকালের বধূরা আধুনিক রাঁধুনী। সেই সময়ের নারীদের মতো তারা পরিশ্রম করে পিঠা-পুলি তৈরিতে মনোযোগী হননা। যান্ত্রিক জীবনে ঝুঁকে গিয়ে আমরা সংস্কৃতি ও বাঙালীত্ব হারাচ্ছি। গ্রামীণ ঐতিহ্য বিমুখ হয়ে যাচ্ছি।