বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
সদরপুরে তিল চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এস এ সোহাগ মার্জিত স্বভাবের কারণে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে টেংগারচর ইউনিয়ন পরিষদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যক্রম উদ্বোধন ফরিদপুরে স্থায়ী প্রশস্ত ব্রিজের দাবীতে মানববন্ধন রামগতিতে হরিনাম মহাযজ্ঞে সরকারি কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধিদের মিলনমেলা কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী অবস্থান প্রেমের ফাঁদে ফেলে জোরপূর্বক অন্তরঙ্গ ছবি তুলে ভাইরাল করানোর ভয় দেখিয়ে টাকা নিতো মেঘলা শিশুদের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা শীর্ষক সভা শ্রীমঙ্গলে আগাম জাতের আনারসের বাম্পার ফলন, ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি চাষিরা ধনবাড়ীতে ৬ ওষুধ ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা

মুক্তিযুদ্ধ ও ‘বন্দী শিবির থেকে’

খবরপত্র ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

একটা ভাষার ও জাতির বড় কবির যে বৈশিষ্ট্য, তার অধিকাংশই শামসুর রাহমানের ছিল। সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্যটি খালি চোখেই ধরা পড়ে তা হচ্ছে, তাঁর কবিতার একটা বড় অংশের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে। তাঁর কবিতা অধিকাংশ সময় পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেতনার মর্মশাঁসকে ধারণ করে শিল্পিত হয়েছে। বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২) কাব্যের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারে চোখ বুজে বলা যায়। এই কবিতার বইয়ে জাতীয়তাবাদের অ্যাসেন্স, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চৈতন্য আর শিল্পিতার একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে।

পূর্ব বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেল হয়ে একত্র হয়েছিল, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আত্মত্যাগের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারা সেই যুদ্ধে গিয়েছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল? হিন্দু নাকি মুসলমান? শামসুর রাহমানের কবিতা লক্ষ করলে দেখব, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাই সেদিন ক্রিয়াশীল ছিল। এ কারণে কবি যখন মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া মানুষের তালিকা করতে যাচ্ছেন, তাঁর সেই তালিকা কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালি জনচৈতন্যের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবটিকে অনায়াসে প্রকাশ করেছে। কবি যে মুহূর্তে বলেন, ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এ কারণে কবি ‘সকিনা বিবি’ আর ‘হরিদাসীর’ আত্মত্যাগের বয়ানকে পাশাপাশি রেখেছেন, সমান মর্যাদা দিয়েছেন। একই প্রবণতা আমরা লক্ষ করি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। সেখানে নজরুল আর রবীন্দ্রনাথকে কবি সমানভাবে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধের মধ্যে একাকার করে দিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘অজর কবিতা’কে যেমন স্বাধীনতার সমার্থক মনে করেছেন, তেমনি নজরুলের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’কেও স্বাধীনতা হিসেবে অনুভব করেছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে সম্প্রদায়ের চিহ্নসূত্র লুপ্ত করতে পেরেছিল, তা শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের পুরাণ ব্যবহারের ধরনেও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ ‘খাণ্ডবদাহন’—এই হিন্দু মিথের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্গত সৌরভ-সুগন্ধির স্মারক হয়ে উঠেছে। একই ধরনের মিথের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় ‘প্রবেশাধিকার নেই’ কবিতায় ‘দুর্বাসা’ মুনি আর ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায় ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’-এর মিথ ব্যবহারের মধ্যে। স্মরণ রাখা দরকার, ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার কবিতা ও সংস্কৃতি থেকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলতে কত কসরতই না করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার বিপরীতে কবিতায় এসব মিথের ব্যবহার জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং এর ধারক-কবির শক্তি-সাহসকে প্রকাশ করে বৈকি।

শুধু অসাম্প্রদায়িকতা নয়, অন্য অনেক দিক থেকেই কবিতার বইটি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে আছে। সব জাতীয়তাবাদী চেতনার লক্ষ্য থাকে জাতির অধিকাংশ মানুষকে একই আবেগ আর স্বপ্নের ছায়ার নিচে নিয়ে আসা। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনাও সেই সাধ্য-সাধনাই করেছে। এ জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের সময় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বারবার অর্থনৈতিক সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদির কথা বলেছে। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ এসবের প্রশ্নে এক হওয়ার ব্যাকুলতা প্রদর্শন করেছে এবং দিনে দিনে এক হয়েও উঠেছে। ফলে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঘরে তুলেছে সফলতার ফসল। ১৯৭১-এ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রায় অস্ত্র ছাড়াই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ঘর ছেড়েছে। স্বাধীনতার আকুল পিপাসা সর্বস্তরের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। আর সবাইকে একই স্বপ্নে শামিল করানোর এই কাজটি করেছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যকার শ্রেণিচেতনা। অর্থনৈতিক সাম্যের যে ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে ছিল, তা-ই সাত কোটি মানুষকে এক পতাকার তলে দাঁড় করেছিল। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্য পড়তে গেলে জাতীয়তাবাদের এই আদর্শটি সহজেই চোখে পড়ে। কবি খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, স্বাধীনতার জন্য কারা কারা অপেক্ষা করছে বা আত্মত্যাগের জন্য ঘর ছেড়েছে। কবির তালিকা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। তালিকায় স্থান পেয়েছে ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’, ‘সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক’, ‘কেষ্টদাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা’, ‘মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি’, ‘রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা’ আর ‘রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো সেই তেজী তরুণ’। একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তিনি যখন স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করেন ‘গ্রাম্য মেয়ে’ থেকে শুরু করে ‘মেধাবী শিক্ষার্থী’ হয়ে ‘মজুর যুবা’ পর্যন্ত। কবিকৃত আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই তালিকা সমকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার ভেতরবাড়িকে উজালা করে আছে। মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ ছিল, এখানে যে সবাই ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার হিসাব মেলাতে মিলিত হয়েছিল, এটা যে গরিব মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল, বন্দী শিবির থেকেতে সেটি কবি বলে ফেলেছেন এক নিশ্বাসে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com