বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ: প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা

ড. মুহাম্মাদ আব্দুল বারী
  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪
ড. মুহাম্মাদ আব্দুল বারী

ভূমিকা: বাংলাদেশী প্রবাসী এখন সারা বিশে^ ছড়িয়ে থাকা অন্যতম বৃহৎ একটি প্রভাবশালী সম্প্রদায় যার সংখ্যা আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন। যারা বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা এরই মধ্যে তাদের নতুন দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বিগত কয়েক দশকের মধ্যে একটিপ্রানবন্ত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এই মানুষগুলো বড়ো অবদান রেখেছে এবং একইভাবে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও তাদের প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
পশ্চিমা বিশে^ বাংলাদেশিদের ইতিহাসের সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে আরো ব্যাপকতর হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে ছাত্র, অর্থনৈতিক অভিবাসী এবং শরণার্থীরা আরও উন্নত কিছু পাওয়ার আকাংখায় বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করেছে।ফলশ্রুতিতে, লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরেন্টো এবং সিডনির মতো বৈশি^ক শহরগুলিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। বর্তমানে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশীই রয়েছেন যারা শিক্ষা, ব্যবসা, প্রযুক্তি এবং শিল্পকলাসহ বিভিন্নক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।

বাংলাদেশে অবদান: স্বদেশে বাংলাদেশী প্রবাসীদের অবদান বহুমুখী। তাদের অর্থনৈতিক অবদান, বিশেষ করে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধুমাত্র ২০২২ সালে, বাংলাদেশ প্রবাসীদের কাছ থেকে আনুমানিক ২২ বিলিয়ন ডলাররেমিট্যান্সপেয়েছে, যা অসংখ্য পরিবারের জন্যশুধুমাত্র আর্থিক স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করে না বরং দারিদ্রতা দূর করতে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার গন্ডি বাড়াতেও সাহায্য করে। বৈদেশিক মুদ্রার এই প্রবাহ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতেও যথেষ্ট সহায়ক হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট, ছোট ব্যবসা এবং প্রযুক্তিস্টার্টআপে প্রবাসীদের বিনিয়োগদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, বৃহত্তর স্কেল প্রকল্পযেমন শিল্প উদ্যোগসহ নানা ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও প্রবাসীরা অবদান রাখে। বিদেশী বিনিয়োগের এই গুরুত্বপূর্ণপ্রবাহের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার এনআরবি বন্ড (অনাবাসী বাংলাদেশী বন্ড) এর মতো উদ্যোগ তৈরি করেছে যার উদ্দেশ্য হলো আরো বড়ো পরিসরে প্রবাসী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।

আর্থিক অবদানের পাশাপাশি, প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রায়ই তাদের নেটওয়ার্ক এবং সম্পদকে জনহিতকর কর্মকান্ডে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করে। এরই আওতায় প্রবাসীরা এতিমখানা, স্কুল, হাসপাতাল এবং অন্যান্য সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পগুলি নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা থাকায় দক্ষতা, জ্ঞান এবং প্রযুক্তিস্থানান্তর সহজতর হয়। তাছাড়া আইটি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো খাতগুলোতেওস্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিপায়। অনেক প্রবাসীপেশাজীবীও রয়েছেন যারা তাদের দক্ষতা শেয়ার করার জন্য এবং এইসব ক্ষেত্রেনেতৃত্বদেওয়ার জন্য বাংলাদেশেও ফিরে যান।

প্রবাসীরা বাংলাদেশী সংস্কৃতি বিশেষ করেবাংলা ভাষা, রন্ধনপ্রণালী, সঙ্গীত এবং ঐতিহ্যকেআন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসীরা তাদের নতুন দেশেনিজ দেশের অনানুষ্ঠানিক কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেন। তারা বিদেশেও বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান রাখেন। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকটগুলোতে স্বদেশের স্বার্থ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও তারা ভূমিকা রাখেন যা প্রকারান্তরে নিজেদের দেশকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

একটি কার্যকর প্রবাসী সম্প্রদায় হয়ে ওঠা: পশ্চিমা দেশগুলোর শিক্ষা ও বিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন খাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উৎকর্ষতা যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক। বাংলাদেশী-আমেরিকান স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, ফজলুর রহমান খান (১৯২৯ – ১৯৮২) আকাশছোঁয়া ভবনের নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি আসলে ব্যতিক্রমধর্মীপ্রতিভার এক অনন্য উদাহরণ।

এই ধরনের সফলতা স্বত্ত্বেও, প্রবাসী অনেক তরুণ তাদের পিতামাতার জন্মভূমির সংযোগ ও সখ্যতা হারাচ্ছে। এমনটা হওয়ার বেশ কিছু কারণও আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাংস্কৃতিক ব্যবধান, পশ্চিমে বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে খারাপ ভাবমূর্তি এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মতো বেশ কিছুনেতিবাচক অভিজ্ঞতা যেগুলো তারা কদাচিৎ বাংলাদেশ সফরের সময় প্রত্যক্ষ করেছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে প্রবাসী তরুণেরা তাদের পৈত্রিক দেশের সাথে পুনরায় সংযুক্ত হতে আগ্রহী হবে। আর এমনটা হলে, এই মানুষগুলো বাংলাদেশের অগ্রগতি সাধন করার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদে পরিণত হতে পারে।
প্রবাসী তরুণেরা আরো ভালো ও কার্যকর অবদান রাখতে পারবেন যদি তারা পশ্চিমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরো বেশি একাডেমিক সফলতা অর্জন করতে পারেন এবং শিক্ষা গ্রহণকালে নিজেদেরকে সততা, সহানুভূতি এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। তাদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, পেশাগত অর্জন এবং মূল্যবোধে উৎকর্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তারা তাদের সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারেন এবং ফলস্বরূপ, স্বদেশেও আরো অর্থপূর্ণভাবে তারা অবদান রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রাখা: যদিও বাংলাদেশী প্রবাসীদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবদানগুলো স্বীকৃত, তবে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই অপ্রয়োজনীয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। অথচ উন্নত শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ এবং বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের উন্নয়নকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

শিক্ষা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জায়গায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির অবকাশ রয়েছে। কেননা, সফল প্রবাসী শিক্ষাবিদ এবং পেশাদাররা জ্ঞান স্থানান্তর করতে পারেন, গবেষণা প্রকল্পে সহযোগিতা করতে পারেন এবং বাংলাদেশের উদীয়মান স্কলারদেরও পরামর্শ দিতে পারেন। এমনটা সম্ভব হলেবাংলাদেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলো শক্তিশালী হবে এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমও সম্প্রসারিত হবে।

প্রবাসীদের সম্পৃক্ত হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা। প্রযুক্তিগত এবং ব্যবসায়িক স্টার্টআপগুলিতে বিনিয়োগ করে, প্রবাসীরা উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে এবং সৃজনশীলতারও বিকাশ ঘটাতে পারে।মেন্টরশিপের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের পথ দেখাতে পারে। এতে করেদেশের মেধা ও অর্থনৈতিক পুঁজি দুটোই বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি,প্রবাসীরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগেও অবদান রাখতে পারেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক ভিত্তি মজবুত হবে, সমাজ কাঠামো সমৃদ্ধ হবে এবং সামগ্রিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রবাসীরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে শেয়ার করেএকটি পাবলিক ডিসকোর্স গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। মিডিয়া, সাহিত্য এবং শিল্পকে সমৃদ্ধ করার মধ্য দিয়েও তারা তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারেন। কারণ তরুণেরা বরাবরই নতুন নতুন ধারনা এবং বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনার প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে। তাছাড়া, পশ্চিমের বিভিন্ন গভর্নেন্স মডেল এবং আইনি কাঠামোর ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের সাথে অভিজ্ঞতা ও মতামত বিনিময় করতে পারলেবাংলাদেশে বিদ্যমান অদক্ষতা এবং সামাজিক বৈষম্যের মতোসমস্যাগুলি মোকাবেলায় স্থানীয় নীতি নির্ধারকেরা কিছু মৌলিক ধারনাও পেতে পারেন।

উপসংহার: পশ্চিমে বাংলাদেশী প্রবাসীরা পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী শক্তি এবং একইসাথে, বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানে তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা সংক্রান্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে, কিংবা উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে, নীতিগত সংস্কারের পক্ষে ভূমিকা রেখে এবং সাংস্কৃতিক নানা উদ্যোগ ও আয়োজন সমর্থন করার মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

নাইন-এলিভেন পরবর্তী সময়ে ইসলামোফোবিয়ার উত্থান এবং অ-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অতি-ডানপন্থী রাজনৈতিক ও মিডিয়ার সরব অবস্থান পশ্চিমা অনেক দেশের সামাজিক ফাটল উন্মোচিত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক বাংলাদেশি তাদের জাতিগত ও ধর্মীয় শিকড়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণ নিশ্চিত করতে পারলে জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং বৈশ্বিক প্রভাবে সমৃদ্ধ একটি ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের যাত্রা করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ যখন ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, তখন স্বদেশ এবং এর প্রবাসীদের মধ্যে সফল ও কার্যকরী অংশীদারিত্ববাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পথ খুলে দিতে পারে। লেখক: শিক্ষাবিদ ও লেখক ব্রিটেনের বিশিষ্ট নাগরিক নেতা, শিক্ষাবিদ, প্যারেন্টিং পরামর্শদাতা,




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com