সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩২ অপরাহ্ন

বুয়েটের আবরার স্টাইলে এবার ঢামেকে শিক্ষার্থীকে নির্যাতন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ডা: ফজলে রাব্বি হলে নৃশংসতা
বুয়েটের পর এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে এক শিক্ষার্থীর ওপর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সহপাঠীদের হাতেই নির্মমতার শিকার হয়েছেন এএসএম আলী ইমাম (শীতল) নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক। তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মাথা, মুখ, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিরামহীন কিল-ঘুষি-লাথি মারা হয়। মাথায় আঘাতের একপর্যায়ে বমি শুরু হলে তাকে টিভি রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় এ ঘটনার শুরু, চলে সোয়া ১২টা পর্যন্ত। মাঝে পুকুর পাড় থেকে টিভি রুমে স্থান পরিবর্তন হয়। এর সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগ এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে তারা এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
ভাগ্যের জোরে সেদিন বেঁচে ফিরলেও জীবন রক্ষায় শীতল ঢাকা ছেড়েছেন। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিক্ষাজীবন। বিষয়টি নিয়ে একটি মামলা হওয়ায় নির্যাতনের তথ্য মেডিকেল কলেজের আঙিনার বাইরে চলে এসেছে। এ ঘটনায় ১৭ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। পরের ৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও কমিটি আরও ১০ দশ দিন সময় বাড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চকবাজার থানায়ও মামলা দায়ের করা হয়। এর তদন্তও শুরু হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, কলেজ হোস্টেলে কোন রুমে নির্যাতনের ঘটনা আমি জানতাম না। যারা অভিযোগ করেছে তাদের মাধ্যমেই এটি জানতে পেরেছি। হলের টিভিরুমে এর আগেও মারধর করা হয় বলে শুনেছি। তবে এ বিষয়ে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বুয়েটের ছাত্রাবাস শের-ই-বাংলা হলের ২০১১ নম্ব^র কক্ষে তাকে ডেকে নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে তার মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে যা বিচারাধীন।

নির্মমতার শিকার ডা. এএসএম আলী ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমি মেডিসিন বিভাগের মাধ্যমে ইন্টার্ন শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহরিয়ার খান আমাকে মেডিসিন না দিয়ে সার্জারিতে দেন। কেন আমাকে মেডিসিন দেওয়া হলো না জানতে চাওয়ায় তিনি দলবেঁধে আমার ওপর নির্যাতন চালান। শীতল বলেন, আমি ঢামেকের ২০১৬-১৭ সেশনের ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক ছিলাম। বর্তমান কমিটির নেতারা এবং আমি ভিন্ন গ্রুপ করায় আমার ওপর এভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। জীবন বাঁচাতে আমি এখন গ্রামের বাড়িতে আছি। তারা বলেছে, আমাকে ঢামেকে ঢুকতে দেবে না, ইন্টার্নও করতে দেবে না। এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (প্রাক্তন শিক্ষার্থী কে-৭০ ব্যাচ) শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ মো. আল-আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ফজলে রাব্বি হলে কোন রুমে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় এটা আমার জানা নেই। হলের অনেক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে বের করে দেওয়া হয়েছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের মেরে বের করে দেওয়া হয়েছে আমি তাদের ফিরে আসতে বলেছি। সম্প্রতি কে-৭২ ব্যাচের এএসএম আলী ইমামের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের হলে গেস্ট রুম আছে, কমনরুম আছে কিন্তু নির্যাতনের কোনো রুম নেই। তাছাড়া যখন মারামারি হয় তখন আমি রুমে ছিলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই মারামারি শেষ হয়ে যায়। ডিউটি রোস্টার নিয়ে ওদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। বিষয়টি আমি পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে মীমাংসা করে দেব বলে জানাই। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই। নির্যাতনের শিকার এএসএম আলী ইমাম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা গণমাধ্যমের এমন প্ররশ্নর জবাবে তিনি বলেন, সে আগের কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ঢামেক কে-৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান আলী ইমামকে ডেকে নিয়ে যায় ফজলে রাব্বি হলের ক্যান্টিনের পুকুর পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই অনেক শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। ইন্টার্নের দায়িত্ব নিয়ে কথা শুরু হয়। এখানে তাকে মারতে থাকে। এক পর্যায়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি কে-৭০ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ মো. আল-আমিনের নির্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হলের টিভি রুমে। সেখানেও কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিউল ইসলামের নেতৃত্বে শাহরিয়ার খান, ফয়সাল ইফতিসহ কয়েকজন তাকে নির্মমভাবে মারতে থাকে। চিৎকার শুনে একই ব্যাচের বন্ধুরা বাঁচাতে এলেও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ মো. আল-আমিনের প্রতিরোধে কেউ ওই রুমে ঢুকতে পারেনি। তিনি রড হাতে নিয়ে দরজার বাইরে পাহারা দেন। এক পর্যায়ে মাথায় আঘাত লাগার কারণে তার বমি শুরু হয়। এ সময় তড়িঘড়ি করে তাকে টিভি রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তার বন্ধুরা তাকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকায় বন্ধুদের সহযোগিতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায় শীতল। তার বন্ধুদের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, সে যেন আর কলেজে ফিরে না আসে। ঢামেক হাসপাতালে তার ইন্টার্ন হবে না।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী গণমাধ্যমকে জানান, বিষয়টি তারা হল প্রভোস্টের নজরে আনেন। প্রভোস্ট তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি দেখছেন বলে জানান।
শিক্ষার্থীরা বলেন, এটাই প্রথম ঘটনা নয়। গত সেপ্টেম্বরে ঢামেক শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শুরু করে গ্রুপিং। যে তাদের কথা শুনে না তার ওপরই নেমে আসে নির্যাতন। এর আগে ১২ জানুয়ারি কে-৭২ ব্যাচের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী শাওন ও সিফাতকে মারতে মারতে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। একইভাবে ৬ জানুয়ারি ফজলে রাব্বি হলের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী শামিমকেও মেরে হলছাড়া করে এই গ্রুপ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এভাবেই চলছে দেশের প্রথম এবং প্রধান মেডিকেল চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্র।
জরুরি বিভাগে চিকিৎসা : ওই রাতে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক গণমাধ্যমকে বলেন, মারাত্মক আহত অবস্থায় আলী ইমাম শীতলকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বিষয়টি পুলিশ কেস বলে তার চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়।
এরপর তার দুই পায়ের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে সেখানে সেলাই করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। সে সময় জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনসহ নানা ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া এক পায়ের ফিবুলা হাড়টিতে ফ্রাকচার সৃষ্টি হওয়ায় ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। তবে এ ধরনের রোগীকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়ার কথা। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কারণে রোগী হাসপাতাল থেকে চলে যান। পরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন বলে শুনেছি।
তদন্ত কমিটি : এ ঘটনায় ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সেখানে তিনি বলেন, ১৪ জানুয়ারি ডা. ফজলে রাব্বি হলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ উদ্ঘাটনে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। কমিটি প্রয়োজনে দুজন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। ঢামেকের নাক-কান-গলা ও হেড নেক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমীকে কমিটির আহ্বায়ক এবং সহকারী পরিচালক ডা. এমএম আক্তারুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে ৬ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন গাইনি এবং অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. শিখা গাঙ্গুলী, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ কাশেম, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচএ নাজমুল হাকিম এবং ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মো. আলাউদ্দিন।
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি ২১ জানুয়ারি অভিযুক্তদের নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়ে লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য প্রদানে চিঠি দেন। এতে ২৪ জানুয়ারি সদস্য সচিবের অফিস কক্ষে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তদের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জানুয়ারি কমিটির চার সদস্য সেখানে উপস্থিত হন অভিযুক্তদের সাক্ষাৎকার নিতে। এরা হলেন অধ্যাপক ডা. নুরুল ফাত্তাহ রুমি, ডা. শিখা গাঙ্গুলী, ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান এবং ডা. আলাউদ্দিন।
কমিটির কাছে নির্যাতিতের লিখিত বক্তব্য : ২৫ জানুয়ারি তারিখে নির্যাতনের শিকার ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম লিখিত বক্তব্য দেন তদন্ত কমিটির কাছে। সেখানে তিনি বলেন, ১৪ জানুয়ারি তারিখে রাত সাড়ে ১১টায় কে-৭২ ব্যাচের ডা. শাহরিয়ার খান আমাকে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলের পুকুর পাড়ে ডেকে নিয়ে যায়। তিনি ইন্টার্নশিপ রোস্টার বিষয়ে কথা বলতে চান। সেখানে তার সঙ্গে বাদানুবাদ হয়। একপর্যায়ে কে-৭৩ ব্যাচের ফয়সাল ইরতেজা বিনা উসকানিতে পেছন থেকে লাথি মারলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এরপর সে আমার মাথায় ক্রমাগত লাথি মারতে থাকে। এ সময় আমি বমি করতে শুরু করি এবং চোখে অন্ধকার দেখি। একপর্যায়ে অজ্ঞাত অনেকে আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে হলের মূল ভবনের কমনরুমে নিয়ে যায়। সেখানে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ডা. আল-আমিন (কে-৭০) আমাকে চড় মারে এবং একটি রড ডা. শাহরিয়ারের হতে তুলে দেয়। তিনি শুধু কে-৭২ ব্যাচের উপস্থিত ছাত্রদের মারতে নির্দেশ দেন। ক্রমাগত আঘাতের একপর্যায়ে আমি আরও দুবার বমি করি। আমার দুই পায়ে মারাত্মক জখম হয়ে রক্তপাত শুরু হয়। একপর্যায়ে আমাকে রুম থেকে বের করে দেয়। আমার সহপাঠী বন্ধু শফিকুল আলম এবং নাহিদা হাসান ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। যেখানে আমার দুই পায়ে সেলাই করা হয়।
লিখিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, ডা. ফজলে রাব্বি হলের কমনরুম/গণরুমসংলগ্ন একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরায় ওই দিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ধারণকৃত ফুটেজ দেখলেই আমার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যাবে। আমার ওপর হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় করা হয়েছে।’ ডা. শাহরিয়ার খানের বক্তব্য : তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হয়ে লিখিত ও মৌখিক জবাব দেন ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহরিয়ার খান। তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ইন্টার্ন ইনডাকশন এবং রোটেশন নিয়ে ডা. আলী ইমাম শীতল আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি ফাঁকা জায়গায় তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। হঠাৎ করে সে আমার মাথায় বেসবলের ব্যাট দিয়ে আঘাত করে। আমার চিৎকার শুনে কে-৭২ ব্যাচের আতিকুল ইসলাম এবং ডা. ইমামসহ অন্যরা আমাকে উদ্ধার করে। এ সময় ডা. আলী ইমামের সঙ্গে আমার উদ্ধারকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়।’
শাহরিয়ার খানের কাছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনা অনেক আগের, ১৪ জানুয়ারির ঘটনা। এসব নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানে নেই। তাছাড়া এটা নিয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা হয়েছে। স্যাররা আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন। তিনি আলী ইমামকে দলবল নিয়ে কেন মারলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সে আমার সঙ্গে ইন্টার্ন প্লেসমেন্ট নিয়ে কথা বলতে চায়। কিন্তু এসব বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া এই ছেলে মানসিক রোগী। সেই আমাকে বেসবলের ব্যাট দিয়ে আঘাত করে।
ডা. মো. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদের বক্তব্য : তদন্ত কমিটির সামনে লিখিত ও মৌখিক জবাব দেন ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. মো. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ঘটনার সময় তিনি ভর্তা-ভাজি রেস্টুরেন্টে ছিলেন। আমি যাওয়ার আগে কিছু শুনিনি। শাহরিয়ার খানের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, শীতলের সঙ্গে তার রোস্টার নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। আমি সভাপতি হিসাবে মীমাংসার চেষ্টা করি। আমার জানামতে তুচ্ছ ঘটনা ঘটেছে। আলী ইমাম শীতলের হলে থাকা নিয়ে যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে সেই চেষ্টা করব।’ তদন্ত কমিটিকে ফুয়াদ মৌখিকভাবে জানান, ইন্টার্ন রেজিস্টার নিয়ে শীতল ও শাহরিয়ারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। দুজনেই আহত হন। শাহরিয়ার জানান, খসড়া তালিকা নিয়েই তার সঙ্গে শীতলের ঝগড়া সৃষ্টি হয়। এছাড়া তদন্ত কমিটি জানতে পারে ঘটনাস্থলে কে-৭২ ব্যাচের ডা. গৌরব বিশ্বাস, ডা. শাশ্বত চন্দন, কে-৭৩ ব্যাচের ফয়সাল, এছাড়া ডা. আতিকুল ও ডা. ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে ২৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমি ঢামেক হাসপাতালের পরিচালককে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি জানান, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রাসঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন। এর জন্য প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা আরও ১০ দিন বাড়ানোর অনুরোধ করা হলো।
এ বিষয়ে কথা হয় তদন্ত কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যেহেতু ঘটনাটি তদন্তনাধীন, তাই এ বিষয়ে তিনি কথা বলবেন না। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির সভাপতি হিসাবে তদন্ত সম্পন্ন হলেও আমি এ বিষয়ে আইনত কথা বলতে পারি না।
মামলা : ইন্টার্ন চিকিৎসক নির্যাতনের এ বিষয়ে গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর চকবাজার মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০৭/৩২৩/৩২৫ ও ৩৪ ধারায় মামলাটি গ্রহণ করেন থানার পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মওদুদ হালদার। মামলার অভিযোগকারী নির্যাতনের শিকার ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম নিজেই। মামলায় ১নং আসামি করা হয়েছে ডা. শাহরিয়ার খানকে। অন্য আসামিরা হলেন ডা. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ, ফয়সাল ইরতিজা, ডা. শেখ সোহেল, ডা. ইশমাম আহমেদ, ডা. সৈয়দ হাসান ইভেন, ডা. ইব্রাহিম হাওলাদার, ডা. তানভীর আহমেদ আকাশসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জন। মামলার বিষয়ে চকবাজার থানার পুলিশ পরিদর্শক মওদুদ হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ফজলে রাব্বি হলে মারামারির ঘটনায় আমরা একটি মামলা নিয়েছি। ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষ হলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে ‘ঢাকা মেডিক্যালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে পিটিয়ে আহত’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিও তুলে ধরা হলো: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে মেরে আহত করার তিন সপ্তাহ পরও দেখা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তদন্তই শেষ করতে পারেনি। অভিযোগকারী চিকিৎসক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন তারই একদল সহকর্মীর বিরুদ্ধে। এমনকি থানায় একটি মামলাও করেছেন, যেখানে তিনি অভিযোগে লিখেছেন, তিনি যে আবাসিক হলটিতে থাকতেন সেখানকার বাসিন্দা আরো অন্তত আটজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক তাকে হত্যার উদ্দেশে লাঠি ও রড নিয়ে হামলা চালিয়েছিল তার ওপর। তারা তাকে মারধর করে রক্তাক্ত করে, যে জন্য তাকে হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে হয়। বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে আবরার ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থী টানা নির্যাতনের পর নিহত হলে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের জন্য আবাসিক হল খোলা রাখা হয়েছে। এসব হলে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনমতো অবস্থান করছেন। ক্লাস না হলেও অনেকের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে এবং ওই সব পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে দেয়া হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষ।
মামলায় যা বলা হয়েছে: অভিযোগকারী শিক্ষানবিশ ডাক্তার গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার চকবাজার মডেল থানায় মামলাটি করেন, যেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, গত ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে ফজলে রাব্বি হলের গণরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানেই তাকে মেরে আহত করা হয়। একপর্যায়ে তার চিৎকারে আশপাশে থেকে কয়েকজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক এসে তাকে উদ্ধার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেন। চিকিৎসা শেষে তিনি থানায় মামলা করেন। এবং ঢাকা ত্যাগ করেন। যে আটজনের বিরুদ্ধে এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে তারাও একই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক বলে উল্লেখ করেন অভিযোগকারী।
গতকাল শনিবার ঢাকার কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে অভিযোগকারী চিকিৎসক নিরাপত্তাহীনতার কারণে আর ঢাকায় আসতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি তিনি তার মোবাইল ফোনও বন্ধ করে রেখেছেন। বিবিসির তরফ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে পুলিশ বলছে, এতদিন হয়ে গেলেও সাক্ষীদের অনীহার কারণে তদন্ত এগোচ্ছে না। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদুদ হাওলাদার জানান, এই ঘটনায় আটজন শিক্ষানবিশ ডাক্তারসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। তদন্তের জন্য গত বৃহস্পতিবার চারজন প্রত্যক্ষদর্শীকে সাক্ষ্য দিতে থানায় ডাকা হয়েছিল, কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে শেষ মুহূর্তে তারা আর থানায় আসেননি।
তদন্ত কমিটি: এ ঘটনার পরপরই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেও সেটি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি। কমিটির সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তারা ১০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দেবে বলে জানাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। কিন্তু এতদিন হয়ে গেলেও ওই চিকিৎসকের শিক্ষানবিশি করার ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন কিংবা তিনি এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কেন এমন প্রশ্নে জেনারেল হক বলছেন, তার সাথে কর্তৃপক্ষের কয়েক দফা কথা হয়েছে, তিনি কখনো কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানাননি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com