মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪০ পূর্বাহ্ন

শিরকের পরিণতি জাহান্নাম

শাহ আলম বাদশা :
  • আপডেট সময় বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ইসলামে ‘ইলম’ বা জ্ঞানার্জন যেমন ফরজ ঠিক তেমনই ফরজ হচ্ছে সালাত, সাওম, হজ, জাকাত, বাইয়াত, জিহাদ, কাতল, সৎকাজ, মানবসেবা ইত্যাদি এবং নেগেটিভ ফরজ বা হারাম হচ্ছে মদ, সুদ, ঘুষ, গালাগাল, মিথ্যা সাক্ষ্য, ওজনে কম দেয়া, ঠকানো, প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, বলাৎকার, হত্যা, গুম ইত্যাদি। তবে সব ফরজের জননী অর্থাৎ ইসলামের সর্বপ্রথম ফরজটাই হচ্ছে ইহকাল-পরকালীন ‘জ্ঞানার্জন’। কারণ পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন ব্যতীত সঠিক বা শিরকমুক্ত ঈমান অর্জন অসম্ভব। এমনকি যথার্থ জ্ঞানার্জনের অভাবে রাসূল সা: ও সাহাবাদের আদর্শবহির্ভূত ৭২ ফির্কাভুক্ত কোটি কোটি মুসলিমও জাহান্নামি হবেন বলে আল্লাহ-রাসূল সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন। এর প্রমাণ হিসেবে নিচে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে সা:-এর কয়েকটি বাণী তুলে ধরা হলো :
১. আল্লাহ শুধু শিরকের গোনাহ মাফ করেন না। এ ছাড়া আর যাবতীয় গোনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরিক করে, সে গোমরাহির মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে (সূরা নিসা, আয়াত ১১৬)।
শিরকমুক্ত ঈমান অর্জনের জন্য যেমন কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান জরুরি, তেমনই ৭২টি জাহান্নামি দলের বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতেও জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। আর এ জ্ঞানার্জনের মূল উৎসই হচ্ছে পবিত্র কুরআন। এ জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকেও জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বপ্রথম যে ফরজটির হাতেখড়ি দেন, তা হচ্ছে-
২. পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ (জমাট রক্তপিণ্ড) থেকে। পাঠ করো, আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না [সূরা আলাক, আয়াত ১-৫]।
আনাস বিন মালিক রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২২৪)।
ইসলামের শিক্ষাকেন্দ্র : সাহাবারা পবিত্র কুরআনভিত্তিক জ্ঞানার্জনে এমনই পাগলপারা ছিলেন যে, হাসান বিন সাবিত, লবিদসহ আরবের বিখ্যাত সাহাবা-কবিরাও ঈমান গ্রহণের পর মসজিদভিত্তিক কুরআন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কবিতা চর্চাই বন্ধ করেছিলেন। রাসূল সা: ও সাহাবারা প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক ইসলামচর্চা নয়, কুরআন ও মসজিদকেন্দ্রিক ইসলামেরই প্রচার-প্রসার করেছেন। তা-ই যদি না হতো, তাহলে ইসলামী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি দুনিয়াবি জ্ঞানার্জনের জন্য অন্তত একজন সাহাবিকেও রাসূল সা: চীন, গ্রিস, ইতালি, পারস্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে নিশ্চয়ই পাঠাতেন! নিজের কুরাইশ গোত্রের মাত্র দশ-বারোজন স্বাক্ষরসম্পন্ন লোকসহ ২০টি গোত্রের কিছু শিক্ষিত লোক ছাড়া মক্কার অধিকাংশ লোকই তখন নিরক্ষর ছিল। রাসূল সা: এ সম্পর্কে সচেতন ও উদ্বিগ্ন থাকলেও মক্কার ১৩ বছর এবং মদিনার ১০ বছরের ইসলামী শাসনামলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সাক্ষরতা ও জ্ঞানার্জনের ওপর নির্ভর করেননি। তিনি ইসলামী জ্ঞানার্জনসহ সাক্ষরতাদানের জন্য মুসলিমদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং শিক্ষিত সাহাবা ছাড়াও অমুসলিম যুদ্ধবন্দীদের (মুক্তির শর্তে) মাধ্যমেও মুসলিমদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে ব্যাপক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি পবিত্র কুরআনকে সংরক্ষণের জন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগেও শিক্ষিত প্রায় ৪৫ জন ‘কাতিবে ওহী’ নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। এবার আসুন জ্ঞান সম্পর্কিত নির্বাচিত কিছু আয়াত জানি :
৩. আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বোধজ্ঞানসম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে (সূরা জুমার, আয়াত ৯)।
৪. এবং আপনি বলুন, ‘ হে আমার প্রতিপালক, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও’ (সূরা তোয়াহা, আয়াত ১১৪)।
৫. আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই আল্লাহকে যথার্থ ভয় করে (সূরা ফাতির, আয়াত ২৮)।
৬. তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের (কুরআনের) জ্ঞানদান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উন্নত করবেন। তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত আছেন (সূরা মুজাদালা, আয়াত ১১।
৭. তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত (প্রজ্ঞা) দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণদান করা হয় এবং বোধজ্ঞানসম্পন্ন লোকেরাই শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে (সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৯)।
৮. আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও (সাক্ষ্য দেন); আল্লাহ ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮)।
৯. প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির ওপরে আছেন সর্বজ্ঞানী (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৭৬)।
১০. মুমিনদের সবার একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাদের প্রত্যেক দলের একাংশ বাইরে বের হয় না কেন, যাতে তারা দীন সম্পর্কে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে (সূরা তাওবা, আয়াত ১২২)।
১১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলে ‘আমরা তা বিশ্বাস করি, সব কিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত’; এবং জ্ঞানীরা ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষাগ্রহণ করে না (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৭।
১২. তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহই তোমাদের শিক্ষাদান করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবগত (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮২)।
১৩. (বলুন) আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছি এবং তোমাদের হিতোপদেশ দিচ্ছি এবং তোমরা যা জানো না, আমি তা আল্লাহর কাছ থেকে জানি (সূরা আ’রাফ, আয়াত ৬২)।
১৪. তিনি সূর্যকে তেজস্বী ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার মনজিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ তা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন (সূরা ইউনুস, আয়াত ৫)।
১৫. বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া আমার নিজের ভালোমন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মুমিনদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই। (সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৮৮)।
১৬. আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন এবং তুমি যা জানতে না, তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তোমার প্রতি আল্লাহর মহানুগ্রহ রয়েছে (সূরা নিসা, আয়াত ১১৩)।
কুরআনি ইলমের অভাবে মুসলিমদের অধিকাংশই মনে করে থাকে যে, মুসলিমরা তো মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজা করে না বা তাদের কাছে সাহায্য চায় না। তাই তারা কিভাবে শিরক করতে পারে? বরং ইহুদি, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই মূল স্রষ্টা ঈশ্বর, গড বা ভগবানের পাশাপাশি বিভিন্ন দেব-দেবীরও সাহায্য চেয়ে শিরক করে থাকে। কিন্তু নাহ, এমন ধারণা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা মুসলিমরা মূর্তি না বানালেও ঈমান-আমলের মাধ্যমে অনেকেই শিরক করে। একমাত্র আইন ও বিধানদাতা হিসেবে আল্লাহ এবং তাঁর উলুহিয়াতের সাথেও মুসলিমরা অজ্ঞতাবশত প্রায়ই কথায়-কাজে শিরক করে অবশ্যই জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবে, যা আল্লাহ ও রাসূলগণ নানাভাবেই নিশ্চিত করেছেন। তাই মহান আল্লাহ মুসলিমসহ নবী-রাসূলগণকেও জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিরক না করতে বারবার সাবধান করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন-
১৭. (হে রাসূল), আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, যদি আল্লাহর শরিক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন (সূরা জুমার, ৬৫)।
১৮. যখন লোকমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বললেন : হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না; কেননা শিরক সবচেয়ে বড় অন্যায় (সূরা লোকমান, ১৩)।
১৯. নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না। আর এটি ছাড়া যাকে ইচ্ছা (তার অন্যান্য অপরাধ) ক্ষমা করে দেন (সূরা নিসা, ৪৮)।
২০. যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর পূজা করে, যে কেয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারা তো তাদের পূজা সম্পর্কেও বেখবর (সূরা আহকাব, ৫)।
২১. তোমরা তাদের ডাকলে তারা তোমাদের সে ডাক শোনে না। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয় না। কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। বস্তুত আল্লাহর মতো তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবে না (সূরা ফাতির, ১৪)।
২২. আর তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগি করো। তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করো। নিকটআত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন বাদি ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো (সূরা নিসা, ৩৬)। মুসলিমদের শিরকের কারণেই জাহান্নামি হওয়ার বিরুদ্ধে রাসূল সা: সাবধান করে বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কিছু শরিক না করে মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কিছু শরিক করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে (মুসলিম, ৯৩)। মুসলিম দাবিদারকে কাফির বলা হারাম : শিরক, কুফরি বা নিফাককারী মুসলিমকেও মুশরিক বা কাফির বা মুনাফিক বলা হারাম। আল্লাহ বলেন,
২৩. হে মুমিনগণ! যখন তোমরা আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন কে বন্ধু আর কে শত্রু তা পরীক্ষা করে নেবে। কেউ তোমাদের সালাম করলে তাকে বলো না, ‘তুমি মুমিন নও’ (নিসা, আয়াত ৯৪)। মুসলিম নামধারী হয়েও যারা ইসলামকে অস্বীকার করে কিংবা নাস্তিক, তারা মুরতাদ বা কাফির হলেও তাদের বিরুদ্ধে আইন হাতে তুলে নেয়া বা মারমুখী হবার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। এমনকি মুসলিম হয়েও আংশিক শিরক, কুফরি বা মুনাফিকিতে লিপ্ত হলেও তাকে মুশরিক, কাফির বা মুনাফিক বলাটা মুসলিমদের জন্য হারাম। এ ব্যাপারে রাসূলের বাণী দেখা যাক। উমার (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, যখন কেউ তার মুসলিম ভাইকে ‘কাফির’ বলে, তখন তাদের উভয়ের মধ্যে একজনের ওপর তা বর্তায়। যা বলেছে, তা যদি সঠিক হয়, তাহলে তো ভালো। নচেত (যে বলেছে) তার ওপর ওই কথা ফিরে যায় (অর্থাৎ সে কাফির হয়ে যায়) (বুখারি : ৬১০৪; মুসলিম: ৬১)।
আবু যার রা: হতে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন : যে কাউকে ‘হে কাফির’ বলে অথবা ‘হে আল্লাহর দুশমন’ বলে ডাকে অথচ বাস্তবক্ষেত্রে যদি সে তা না হয়, তাহলে তার (বক্তার) ওপর তা বর্তায় (রিয়াদুস সালিহীন : ১৭৪২)। সাবিত ইবন যাহহাক রা: হতে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেন : ঈমানদারকে লা’নত করা, তাকে হত্যা করার সমতুল্য। আর কেউ কোনো ঈমানদারকে কুফরির অপবাদ দিলে তাও তাকে হত্যা করার সমতুল্য হবে (বুখারি : ৬১০৫)।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com