রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৫ পূর্বাহ্ন

মহানবীর বীরত্বপূর্ণ জীবন

ফারযানা:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী : ‘অতএব যারা দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত ক্রয় করে তারা যেন আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে; এবং যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর নিহত অথবা বিজয়ী হয়, তাহলে আমি তাকে মহান প্রতিদান প্রদান করব।’ (সূরা নিসা-৭৪)

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিশারদ, সমরনায়ক। সমগ্র দুনিয়তে একত্ববাদের বীজ বপন করতে, ইসলামকে পত্রপল্লবে সুশোভিত করতে, বাতিলকে পদাবনত করতে পদে পদে অনেক বাধার সম্মুখীন হন। সেসব বাধা কখনো সন্ধিতে, কখনো সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মোকাবেলা করতে হয়েছে। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়, তাঁর জীবদ্দশায় পরিচালিত ২৭টি গাজওয়া, ৬০টি সারিয়া। অন্য বর্ণনায় ২৩টি গাজওয়া, ৪৩টি সারিয়া সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনের সব কথা ও কাজ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের বীরত্বের প্রতীক।
সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দৃঢ় মনোবল, মজবুত ঈমান ও বিরল বীরত্বের স্বাক্ষর রাখতেন। তাঁর সমরজীবনের বীরত্ব ছিল স্বভাবজাত। প্রত্যেকটা স্তরে বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল অকল্পনীয়। কৈশোরকালীন বয়সে চাচাদের সাথে ফিজারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
নবুয়াতপ্রাপ্তির সূচনাতেই সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। একে একে প্রাচীরসম বাধার সম্মুখীন হন। ভোগ করেন কঠিন যন্ত্রণা। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ছেড়ে দেননি বাতিল শক্তিকে। বুকে ছিল দুর্বার সাহস, অটল ছিল পদযুগল। তাঁর সমরকৌশল, আর বীরত্ব দিয়ে শত্রুদের কঠিনভাবে প্রতিহত করেছেন।
কাফির মুশরিকরা তাঁকে আল্লাহর দ্বীন থেকে হটাতে নানা রকম প্রলোভন দিয়েছিল। দিয়েছিল হুমকি-ধামকি। রাসূল সা: অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা নিয়ে বলেছিলেন ‘আল্লাহর শপথ! এক হাতে সূর্য আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি পশ্চাৎপদ হবো না।’
বীরত্বের অভূতপূর্ব নজির দেখিয়েছেনÑ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় জালিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মজলুমের অধিকার ছিনিয়ে আনেন।
ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমগ্র বিশ্ববাসীকে এনে জান্নাতে অমৃত সুধা পান করানোর জন্য রাসূল সা: বিভিন্ন যুদ্ধ করেছেন। নিজের ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় কাফির মুশরিকের হামলার প্রতিরোধ করতে হয়েছে। তার ছিল কিছু সমরনীতি। যুদ্ধের মধ্যে সৈন্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব এবং একক গুণের অধিকারী ছিলেন।
যখন কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন, তখন যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের উপযোগী সরঞ্জামাদি, উট, ঘোড়া, যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সম্পদ জোগান দেয়া এবং সাহাবায়ে কেরামকে সেসব সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। রাসূলুল্লাহ সা: এ সব কিছুতে কখনোই বিধিবহির্ভূত কোনো অন্যায় ব্যবস্থা, উৎপীড়নের পথ অবলম্বন করেননি।
যুদ্ধ শুরুর আগে রাসূল সা: কিছু নিয়মনীতি অবলম্বন করতেন। যুদ্ধের স্থান নির্বাচন, সেনাবাহিনী বিন্যাস, সমর কৌশল, সমরাস্ত্রের ব্যবহার বিধি, আক্রমণ, পশ্চাৎপসরণ, যুদ্ধের মাঠে অবস্থান ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে সাহসিকতা, সতর্কতা ও দূরদর্শিতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।
যুদ্ধ সূচনা মুহূর্তে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে সালাতে দাঁড়াতেন। দোয়া করতেন আল্লাহর কাছে।
সর্বপ্রথম বড় সমরযুদ্ধ ছিল বদর। যা ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এক মহান ও অবিস্মরণীয় ঘটনা। কাফিররা মদিনায় আক্রমণ করলে, রাসূল সা: এবং তাঁর ঈমানদীপ্ত সাথীরা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করলেন।
মহান আল্লাহর নির্দেশে, যা ছিল সূরা আনফালের ৬৫ নং আয়াতে, ‘হে নাবী! মুমিনদেরকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ কর, তোমাদের মধ্যে যদি ২০ জন ধৈর্যশীল মুজাহিদ থাকে তাহলে তারা ২০০ জন কাফিরের ওপর জয়যুক্ত হবে, আর তোমাদের মধ্যে ১০০ জন থাকলে তারা এক হাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে, কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই, কিছুই বোঝে না।
রাসূল সা:-এর প্রাচীরসম যুদ্ধ কৌশল দেখে মক্কার কাফির মুশরিকরা বলতে থাকে, মুসলিমরা এমন সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে যে আমরা আমাদের একটি প্রাণের বিনিময় ছাড়া, তাদের একটি প্রাণনাশ করতে পারব না।
রাসূল সা:-এর সমরকৌশলের কাছে কাফির শক্তি টিকে থাকতে পারেনি। চরম বিপর্যস্ত হয়ে পরাজয় বরণ করে।
উহুদের যুদ্ধে অন্য একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যুদ্ধে নেতার আনুগত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি মাত্র ভুল, একটি মাত্র অসচেতনতায় ঘুরে যেতে পারে যুদ্ধের মোড়। রাসূল সা:-এর সমর নির্দেশনা ভুলে তীরন্দাজ বাহিনী ডেকে আনল চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয় শিক্ষা দেয় নেতার আনুগত্য মান্য করা অপরিহার্য। উহুদের কঠিন পরিস্থিতিতেও রাসূল সা: সম্পূর্ণ সুচারুভাবে সৈন্যবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনেন।
তাঁর সমর শিক্ষা হলো : ধৈর্য ও স্থিরতার মাধ্যমে বিজয় লাভ সম্ভব। খন্দকে আমরা রাসূল সা:-কে দেখতে পাই, তিনি সাহাবায়ে কেরাম থেকে পরামর্শ নিয়ে পরিখা খনন করতে। সমর পারদর্শী সালমান ফারসি রা: ছিলেন প্রধান পরামর্শদাতা। এই যুদ্ধে শুধু সমরকৌশলের কারণে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল। রাসূল সা: কখনো নিজেকে বড় মনে করতেন না। একেবারে সাদা দিলের মানুষ ছিলেন। যুদ্ধে কারো মতামত গ্রহণযোগ্য হলে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতেন। এটাও ছিল রাসূল সা:-এর সমরদর্শিতার পরিচয়।
আবার দেখা যায় যে, রাসূল সা: হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ না করে সন্ধি করলেন। এটা যদিও মুসলিমদের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু এই সমরকৌশলটির ফলাফল ছিল সুস্পষ্ট বিজয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।’ (সূরা ফাতহ-১)
এভাবে হাজারও সমরকৌশল একেকটা যুদ্ধে পরিলক্ষিত হয়। নিজের বীরত্বকে বুদ্ধিদ্বীপ্তভাবে পরিচালনা করতেন। যেগুলো অভাবনীয়, অকল্পনীয়। যেমন খায়বারে দুর্গ অবরোধ, তাবুকে সবর ও ক্ষমা প্রদর্শন, তায়েফে সুদীর্ঘ ৪০ দিন অবরোধ করে রাখা, হুনাইনে দুঃসাহসিক উপমা স্থাপন করেছেন, মক্কা বিজয় ছিল তাঁরই সমরজীবনের দুর্দান্ত ফসল। বিনা রক্তপাতে বিশাল বিজয়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও লক্ষ্যিত হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। মানুষ এমন বিস্ময় ইতোপূর্বে অবলোকন করেনি।
সাতটি মহান যুদ্ধের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সংখ্যায় নয় বরং কৌশলই মূল বিষয়। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বদর যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ৩১৩ জন। কাফির সৈন্য সংখ্যা এক হাজার। ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে উহুদে মুসলিম সৈন্য ৭০০ জন, কাফির সৈন্য সংখ্যা তিন হাজার ৫০০ জন। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে খন্দকে মুসলিম সৈন্য তিন হাজার জন। কাফির সৈন্য ২৪ হাজার জন। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে খায়বারে মুসলিম সৈন্য এক হাজার ৪০০ জন। আর কাফির সৈন্য ২০ হাজার জন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ে মুসলিম সৈন্য ছিল ১০ হাজার জন। বিপক্ষদল ছিল মক্কার সব অমুসলিম। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম সৈনিক ১২ হাজার জন। বিপক্ষ দল ছিল হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের লোকজন। ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে তাবুকের যুদ্ধে মুসলিম ছিল ৩০ হাজার জন। বিপক্ষে ছিল লক্ষাধিক অমুসলিম।
দেখা যায়, রাসূল সা: পরিচালিত এসব যুদ্ধে মুসলিম অমুসলিম মিলে খুব কম ছিল নিহতের সংখ্যা। যা ছিল সমকালের ইতিহাসে অতি নগণ্য। অপরপক্ষে এই সল্প সংখ্যক নিহতের বিনিময়ে বেঁচে গেল লাখো মানুষ।
বর্বরতার দাফন হলো/ শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এলো।
রাসূল সা:-এর বীরত্ব ছিল রহমতের চাদরে আবৃত। কেবল জিহাদের ময়দানেই তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করতেন, আর তা কেবল আল্লাহর কালিমাকে উঁচু করার জন্য। নবীজী সা: কখনো ব্যক্তিস্বার্থে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না, কেবল আল্লাহর রাহে ছাড়া কাউকে আঘাত করতেন না। রাসূল সা:-এর সমরাদর্শ ছিল সব যুগের, সব সমর নায়কের অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য সর্বোত্তম আদর্শ।
তথ্যসূত্র : আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থ। ড. রাগিব সারজানির নবীজী গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাস গ্রন্থ।
লেখক : নিবন্ধিত প্রভাষক, আরবি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com