দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস মার্চের অষ্টম দিন আজ । ভাষা সমস্যার জের ধরে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন বৈষম্যের বিরোধিতাসহ নানা যৌক্তিক অধিকার আদায়ে সংঘটিত হয়েছিল এই আন্দোলন। ঊনিশশ’ একাত্তর সালের এই দিনে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। গোটা ঢাকা শহর কালো পতাকার শহরে পরিণত হয়। এদিকে ইতোমধ্যে বিদেশীদের ক্রমে ঢাকা ত্যাগ করতে দেখা গেলো। এদিন রাজপথে মিছিলকারীরা বাঁশের লাঠি নিয়ে আসে। এত বিদ্রোহ কেউ কখনো দেখেনি। এমন গতিশীল আর বেগবান আন্দোলন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর কখনো ঘটেনি।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ তাঁর এই ঘোষণার পরপরই জনগণ মানসিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এরপর শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, অবিলম্বে সামরিক আইন বিলোপ এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অহিংস আন্দোলন চলবে। মার্চের ৭ তারিখে টিক্কা খানকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ও জিওসি নিযুক্ত করা হলেও তিনি তখনো এসে পৌঁছাননি।
অন্যদিকে বর্তমান বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলীবর্ষণ সম্পর্কে সেদিন সামরিক সরকার একটি প্রেসনোট প্রকাশ করে। প্রেসনোটে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর গুলীতে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে যা প্রকাশ করা হচ্ছে তা ‘মিথ্যাচার’ অভিহিত করে স্বীকার করা হয়, গত সাত দিনে ১৭২ জন নিহত ও ৫৮ জন আহত হয়েছে। এদিন বেশ ক’জন বৃটিশ ও ১৭৮ জন জার্মান নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিন রাতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে হরতাল-মিছিল করতে এক নির্দেশনামা জারি করেন। এতে বলা হয়, সকল ব্যাংক ব্যাংকিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এবং বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজের জন্য খোলা থাকবে।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নোক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, ১. খাজনা-ট্যাক্স বন্ধে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোনো কোনো অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে। ৩. রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয়। তাহলে রেলওয়ে শ্রমিক ও বন্দর শ্রমিকরা সহযোগিতা করবে না। ৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না। অন্যথায় এ সকল প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে বাঙালিরা সহযোগিতা করবে না। ৫. কেবল স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাংক, টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে। ৬. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ৭. ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না। ৮. প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে। ৯. অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে কোনো সময় উপরোক্ত পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে। ১০. প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। যদিও উপরোক্ত কর্মসূচি এক সপ্তাহের জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল, তবু পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, অবস্থার ক্রমাবনতিতে এই কর্মসূচি পুনরাদেশ ছাড়াই বাঙালিরা ১৫ মার্চ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পালন করেছিল।
ওই গ্রন্থে ৮ মার্চের ঘটনা তুলে ধরে আরো বলা হয়, “বৃটেনে বসবাসরত দশ হাজার বাঙালি স্বাধীন বাংলার দাবিতে ল-নস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সেদিন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন।”
৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের মাত্র একদিন পরেই লুসাক লিখেন, “এখন এটা দুটি জাতির দেশ। দুটি জাতির আচার-আচরণ, খাদ্য ও ভাষা এক নয়। তাই ধর্মের বন্ধন দুটি জাতিকে একত্রীভূত করে রাখতে পারেনি। কোন আধুনিক জাতি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কৃষ্টিগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে কোন কর্মকা-ই পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী করা সহজ নয়। পাকিস্তানী নেতারা দেশে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে কারণে দেশটিকে (পাকিস্তান) দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করা ব্যতীত এ সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না”- রিপোর্টের এক অংশে ডেভিড লুসাক এই মন্তব্য করেন।
পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি লিখেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে মনে হয় নেতাদের পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্থান পূর্ব-পাকিস্তানকে প্রকৃতপক্ষেই একটি কলোনী হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল। বর্তমানে প্রথমবারের মত তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার ফিরে পেয়েছে বলে লুসাক তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন।